|

নিরাপদ সড়কের দাবীতে শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলন নিরসনে কালক্ষেপণ কার স্বার্থে?

প্রকাশিতঃ ১১:৪৯ অপরাহ্ণ | আগস্ট ০২, ২০১৮

হুমায়ুন আহমেদ সৃজন:

রাজধানীর অন্যতম প্রধান ও ব্যস্ততম সড়কে বাসের অপেক্ষায় বাসস্টপে দাঁড়িয়ে থাকা শিক্ষার্থীদের জাবালে নুর পরিবহনের একটি যাত্রীবাহী বাস চাপা দিলে ঘটনাস্থলে দুজন নিহত এবং বেশ কয়েকজন গুরুতর আহত হয় যাদের মধ্যে আবার কয়েকজন মৃত্যুবরণ করেছে এমন খবর পাওয়া যাচ্ছে। এর পরপরই রাস্তায় নেমে আসে আহত নিহতদের সহপাঠী সহ আশেপাশের কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা, বিক্ষুব্ধ হয়ে তারা বেশ কিছু গাড়ী ভাঙচুরও করে ও সেই সড়কে যান চলাচল বন্ধ করে দেয় এবং পরিস্থিতি বিবেচনায় তা খুব স্বাভাবিক একটা ব্যাপার।

এরকম অনাকাঙ্ক্ষিত একটি দুর্ঘটনায় সহপাঠীদের বিক্ষুব্ধ হওয়াটা খুব স্বাভাবিক ছিলো, এটাকে দুর্ঘটনা হিসেবে মেনে নেয়াটা একেবারেই সহজ কথা নয় এবং সেটা কারোর কাছেই নয় বরং এটিকে বাস চালকদের বেপরোয়া চালনার কারনে সংঘটিত খুন হিসেবেই দেখা উচিত বলে মনে করি। এরপর সেই ঘটনা বিষয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে মাননীয় নৌপরিবহণ মন্ত্রী এবং বাংলাদেশে পরিবহণ মালিক শ্রমিক সংগঠনের নিয়ন্ত্রক জনাব শাহজাহান খানের হাসিমুখে দেয়া জবাবের একটি ছবি ও ভিডিও চিত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পরে। মুহুর্তেই দেশের ট্রেন্ডিং টপিকে পরিনত হয়ে ভাইরাল হয়ে যায় সেই হাসিমুখ, চারিদিকে নিন্দার ঝড় উঠে। আর বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে এটা যেন জলন্ত আগুনে পেট্রোল নিক্ষেপ করার মত ঘটনায় পরিণত হয়। শিক্ষার্থীরা সেই দুর্ঘটনায় জড়িত সকলের বিচারের দাবীর পাশাপাশি মন্ত্রীর ক্ষমা চাওয়া ও পদত্যাগের দাবীতে আন্দোলন শুরু করে এবং উই ওয়ান্ট জাস্টিস স্লোগানে সমগ্র ঢাকার রাজপথ দখলে নিয়ে নেয় বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরা। আন্দোলন ক্রমেই চাঙ্গা হতে থাকে, শহরবাসী অধিকাংশ মানুষও এই আন্দোলনে নিরব সমর্থন ব্যক্ত করেন।

পরিচিত অনেককেই দেখেছি বাড্ডা থেকে মিরপুর, উত্তরা থেকে শাহবাগ হেটে ও রিকশায় করে পৌঁছালেও কেউ বিরক্ত হননি বরং শিশুদের এই দাবীর সাথে সহমত পোষণ করেছেন। পরবর্তীতে নৌমন্ত্রী তার বক্তব্যের জন্য দুঃখপ্রকাশ করেন এবং সেই হাসি অন্য একটি কারনে ছিলো বলে দাবী করেন। কিন্তু শিক্ষার্থীরা নিরাপদ সড়কের দাবীতে আন্দোলন চালিয়ে যান এবং এক পর্যায়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কোথাও কোথাও পুলিশ তাদের উপর চড়াও হয়, সামান্য লাঠিচার্জ ও রাবার বুলেট নিক্ষেপের ঘটনাও ঘটে যেখানে কয়েকজন শিক্ষার্থীর আহত হবার রক্তমাখা ছবি ও ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। আর এর পরপরই পুলিশি অ্যাকশনের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে শিক্ষার্থীরা, উই ওয়ান্ট জাস্টিসের পাশাপাশি পুলিশের বিরুদ্ধেও তারা স্লোগানে ফেটে পড়ে। এই ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তিনজন চালককে আটক করলেও পরবর্তীতে এদের কারও কাছেই বাস চালানোর লাইসেন্স পাওয়া যায়নি, রাজধানীতে পাবলিক পরিবহণ হিসেবে যেসমস্ত বাস চলছে তার বেশিরভাগেরই নেই কোন ফিটনেস সার্টিফিকেট, অধিকাংশ বাস চালকেরই নেই লাইসেন্স এমনকি শিশুরাও বাসে ড্রাইভিং করছে এমন ভিডিও দেখছি আমরা।

দোষী চালককে গ্রেফতার করে প্রচলিত আইনে নয় বরং দ্রুত বিচার আইনে যদি তার বিচার করে উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিতে দৃশ্যমান কোন পদক্ষেপ সরকার বা সংশ্লিষ্ট দপ্তর গ্রহণ করত তাহলে আজকে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি কখনোই হতোনা। কাকে বাঁচাতে, কাকে আড়াল করতে বা ঠিক কার স্বার্থে এই ঘটনায় দোষীদের বিচারের কার্যক্রম শুরুর বিপরীতে কালক্ষেপণ করা হচ্ছে এটা বোধগম্য নয় আমার কাছে। কয়েকটি ঘটনার কথা বলি যেমন পুলিশকে জড়িয়ে ধরে হাতজোড় করে বন্ধু মারা গেছে এজন্য প্রতিবাদ করছে তাদের যেন বাধা দেওয়া না হয় এমন ছবি আমরা দেখেছি, আমরা দেখেছি অ্যাম্বুলেন্স ও ইমার্জেন্সি সার্ভিসের গাড়িগুলিকে ছাত্ররা কিভাবে আন্দোলনরত এলাকা পার করে দিচ্ছে, পঙ্গু মহিলাকে বহনকারী রিকশা অথবা ৬ মাসের বাচ্চা কোলে এক প্রাইভেটকার আরোহী নারীকে কিভাবে নিজেরা দায়িত্ব নিয়ে রাস্তা পার করে দিয়েছে এই কোমলমতি শিশুরা এমনকি বিভিন্ন পাবলিক পরিবহনকে থামিয়ে চালকদের লাইসেন্স চেক পর্যন্ত করছে এরা আর লাইসেন্স না থাকলে সেই গাড়ি আটকেও দিচ্ছে এরা যা আজ পর্যন্ত কেউ পারেনি এই দেশে তাই করে দেখিয়েছে এরা। এদের বিরুদ্ধে বাস ভাঙার অভিযোগের পাশাপাশি এসবকিছুও দেখা সকলের দায়িত্ব, হ্যাঁ অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা যে ঘটেনি তাও বলছিনা আর এটাও সত্যি যে এরা যখন লাইসেন্স চেক করছিলো তখন ৩য় পক্ষ বাস ভাঙার চেষ্টা করলে এই আন্দোলনরতরাই তাকে আটক করে পুলিশে পর্যন্ত দিয়েছে। বিগত ২ যুগের অধিক সময় ধরে বাংলাদেশে নিরাপদ সড়কের দাবীতে আন্দোলন করে আসা জনপ্রিয় অভিনেতা ইলিয়াস কাঞ্চন এই ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ কর্মসূচীর ডাক দিয়েছেন ঘটনার পরপরই, এই আন্দোলনে সমর্থন দিয়েছেন বিভিন্ন পেশার উল্লেখ্যযোগ্য বেশ কয়েকজন মানুষ কিন্তু এই ইস্যুতে যাদের দৃষ্টি দেয়া সবচাইতে বেশি জরুরি ছিলো তাদের মধ্যে উল্লেখ্য করার মত তেমন কাউকে দেখিনি আমরা এমনকি এই ঘটনার সমাধানে সরকারের তরফ থেকে আশানুরূপ কোন পদক্ষেপ বা কর্মকান্ডও চোখে পড়েনি কারও।

কেন যেন মনে হচ্ছে এই ইস্যুতে কালক্ষেপণ করতে চাইছেন সকলে, নিরাপত্তার খাতিরে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সাময়িক ভাবে বন্ধ করে দেয়ার পাশাপাশি আগামীকাল সারাদেশে সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে সরকার কিন্তু কেন? শিক্ষার্থীরা তো কারও নিরাপত্তায় হুমকি নয় বা হুমকি হতে পারে এমন কোন পদক্ষেপ তারা নেয়নি বরং শিক্ষার্থীরা তো সড়কে সকলের নিরাপত্তা নিশ্চিতের দাবীতেই রাজপথে নেমেছে এটা আমরা ভুলে যাচ্ছি কেন।

আমরা কেন এটা বুঝতে পারছিনা যে এরা যা করছে তা কেবল সহপাঠী হারানোর বেদনায় শোকে কাতর হয়ে। এদের আবেগে যেকোন ধরণের ষড়যন্ত্র খোঁজাটা কেবল বোকামি ছাড়া আর কিছু নেই, বরং সরকারের উচিৎ এদের ৯ দফা যৌক্তিক দাবী বাস্তবায়নের জন্য কাজ করা, দোষী চালকদের দৃষ্টান্তমুলক শাস্তি নিশ্চিত করে বিচারের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে এদের পক্ষে অবস্থান নিয়ে রাজপথ থেকে এদের নিরাপদে নিজস্ব শ্রেণীকক্ষে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করা। সারাদেশের সকল মানুষের জন্য নিরাপদ সড়কের দাবীতে রাস্তায় আন্দোলনরত এই কোমলমতি শিক্ষার্থীরা তাদের পাশে কাউকে পাচ্ছেনা, এখন পর্যন্ত তারা একাই লড়ে যাচ্ছে অথচ এই আন্দোলন সফল হলে তার সুবিধাভোগী কিন্তু আমরা সকলেই হবো তা কেন অনুধাবন করতে পারছিনা।

পরিশেষে বাংলাদেশে সড়কে প্রাণহানির ঘটনা নতুন কিছু নয়, প্রতিদিন গড়ে সারাদেশে অন্তত ৮ জন মানুষের নিহত হবার খবর পাওয়া যায় আর এই আন্দোলনের কারনে যদি কিছুটা হলেও তা কমে আসে, যদি অল্প একটু হলেও সড়কটা নিরাপদ হয় এবং এই আন্দোলনে যদি কিছুটা সুফল পাওয়া যায় তাতে ক্ষতি কি?

লেখকঃ হুমায়ুন আহমেদ সৃজন

সংবাদকর্মী, অনলাইন ও সোশ্যাল অ্যাক্টিভিস্ট।

মোবাইলঃ ০১৭১৯২০৮৩৪০, ই-মেইলঃ nirobota4humayun@gmail.com

Print Friendly, PDF & Email