|

ময়মনসিংহে কিস্তিতে পাওয়া যাচ্ছে অস্ত্র

প্রকাশিতঃ ৪:৩০ অপরাহ্ণ | সেপ্টেম্বর ০৯, ২০১৮

সাঈদুর রহমান রিমন: ময়মনসিংহ দুর্ধর্ষ অস্ত্রবাজ সন্ত্রাসীদের নিরাপদ ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছে। তারা হাত বাড়ালেই মিলিয়ে দিচ্ছে আগ্নেয়াস্ত্র। এ অবস্থায় অলিতে-গলিতে পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে অস্ত্রের কেনাবেচা। কিস্তিতে বিক্রির বিশেষ সুযোগ দেওয়ায় কিশোর-তরুণদের হাতেও অস্ত্রশস্ত্র সহজলভ্য হয়ে উঠেছে। এ বাস্তবতায় গড়ে উঠেছে কিশোর গ্যাং। স্কুলপড়ুয়ারাও হয়ে উঠছে অস্ত্রবাজ। সব মিলিয়ে সীমাহীন উৎকণ্ঠায় আছেন মানুষ।

এক অনুসন্ধানে জানা গেছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নাকের ডগায় উত্থান ঘটেছে শীর্ষ সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর। এদের বিরুদ্ধে জনগণ মুখ খোলার সাহস পাচ্ছেন না। পুলিশও কিছু করছে না। এ বাস্তবতায় নগরীর ঐতিহ্যবাহী আকুয়া মহল্লা সাম্প্রতিক সময়ে হয়ে উঠেছে সন্ত্রাসের জনপদ। মাদক, অস্ত্র, চাঁদাবাজি আর রাজনৈতিক ক্যাডারসহ উঠতি অপরাধীদের গ্যাং স্পট হয়ে উঠেছে এলাকাটি। এরই মধ্যে সেখানে দফায় দফায় বন্দুকযুদ্ধ, ককটেল-বোমাবাজি, কুপিয়ে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। শান্ত গ্রুপ, আজাদ গ্রুপ, ফরিদ গ্রুপ, টিটু গ্রুপ, মাসুম গ্রুপসহ নানা নামে গড়ে উঠেছে অন্তত দুই ডজন গ্রুপ। এদের দৌরাত্ম্যে পুরো ময়মনসিংহ এখন কাঁপছে। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় নানা বাহিনীর বেপরোয়া কর্মকাণ্ড প্রশাসনের ওপরও প্রভাব বিস্তার করে চলছে। অস্ত্রবাজ গ্রুপগুলো আধিপত্য বিস্তার করতে গুলি ও দেশীয় অস্ত্র দিয়ে তাণ্ডব চালিয়ে বিভিন্ন এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করছে। কেউ প্রতিবাদ করলে বা মামলা দিতে চাইলে বাড়িঘরে উঠে অস্ত্র ঠেকিয়ে স্বজনদের হত্যা, গুম করে ফেলার হুমকি দেওয়া হচ্ছে। জানা গেছে, গত আগস্ট মাসের পূর্ববর্তী দুই মাস ধরে ময়মনসিংহ নগরীর আকুয়া এলাকাতে অস্ত্রের ঝনঝনানি ও একের পর এক বন্দুকযুদ্ধের ঘটনায় গোটা ময়মনসিংহবাসী আতঙ্কিত হয়ে ওঠেন। সন্ত্রাসী বনাম সন্ত্রাসী এবং সন্ত্রাসী বনাম পুলিশের মধ্যে সংঘটিত বন্দুকযুদ্ধে বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার হতে দেখেছেন ওই এলাকার বাসিন্দারা। এত আগ্নেয়াস্ত্র কীভাবে নগরীতে ঢুকেছে, কীভাবে তা হাতে হাতে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে— তা জেলার গোয়েন্দা কর্মকর্তাদেরও ভাবিয়ে তুলেছে। অবৈধ অস্ত্রের বিস্তার : বৃহত্তর ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট, ধোবাউড়া, নেত্রকোনা, জামালপুর, শেরপুরের সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে ময়মনসিংহে ঢুকছে অবৈধ পিস্তলসহ ক্ষুদ্র অস্ত্র। মেইড ইন ইউএসএ লেখা এসব পিস্তল ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট চক্রগুলো ভারতের তৈরি ফাইভ স্টার পিস্তল আমদানি করে থাকে সবচেয়ে বেশি। সীমান্তে এসব খুব একটা ধরা না পড়লেও ময়মনসিংহ শহর ও আশপাশ থেকে প্রায়ই অস্ত্র উদ্ধারের খবর মিলছে। তবে সংশ্লিষ্ট অস্ত্র ব্যবসায়ীরা স্বীকার করেন, চোরাচালানে আসা অস্ত্রের তুলনায় আটক হওয়া অস্ত্রের পরিমাণ খুবই কম। চোরাচালানে আসা অবৈধ অস্ত্রই ময়মনসিংহকে অশান্ত করে রাখছে। অবৈধ অস্ত্রধারীরা রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয়ে নিজেদের দাপট নিশ্চিত করেছে। জানা গেছে, অস্ত্র চোরাচালানিরা সাধারণত একসঙ্গে একটা-দুইটার বেশি অস্ত্র বহন করে না। ফলে সীমান্তের যে কোনো দিক দিয়েই আসা-যাওয়ার সুবিধাটা ব্যবহার করতে পারে তারা। আকারে ছোট হওয়ায় চোরাই পথে এসব অস্ত্র আনা-নেওয়াও সহজ। এদিকে সহজে লুকিয়ে রাখা যায় বলে ব্যবহারকারীদের কাছেও এসব অস্ত্রের চাহিদা বেশি। ময়মনসিংহে অস্ত্রের বাজারে কীভাবে কেনাবেচা হয়, তা জানা নেই বেশিরভাগ মানুষের। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সাধারণত দালালেরা ক্রেতা ও বিক্রেতার যোগাযোগ ঘটিয়ে দেয়। বিক্রেতারা পছন্দের অস্ত্র হাতে তুলে দেওয়ার আগে টাকা আদায় করে নেয়। পরে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ক্রেতাকে জানিয়ে দেওয়া হয়, ‘আপনার কেনা অস্ত্রটি অমুক ব্রিজের নিচে কিংবা অমুক গাছের ডালে ঝুলিয়ে রাখা আছে— এখনই তা সংগ্রহ করে নিন।’ ময়মনসিংহে র‌্যাব-১৪, পুলিশ ও ডিবি সদস্যরা প্রায়ই অভিযান চালিয়ে অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করে। অস্ত্রশস্ত্রের বাহকরা গ্রেফতার হলেও সিন্ডিকেট তৎপরতায় দ্রুতই তারা জামিনে বেরিয়ে আসে। ময়মনসিংহের সচেতন নাগরিকরা বলছেন, দেশের অন্য সব জেলা শহরের তুলনায় ময়মনসিংহের সন্ত্রাসীরা অনেক বেশি সশস্ত্র। প্রায়ই এখানে অস্ত্রের ঝনঝনানি বেশি।

সারা দেশের মতো ময়মনসিংহে অবৈধ অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে। রাজনীতিবিদরা নিজেদের আধিপত্য ধরে রাখতে এ কাজ করেন। অস্ত্রধারীরাও ডাকাতি, ছিনতাই, মাদক ব্যবসা চালানোর কাজে রাজনীতিবিদদের ব্যবহার করে। এর আগে ময়মনসিংহ জেলা গোয়েন্দা পুলিশের একটি দল বিসিক শিল্পনগরী এলাকায় অভিযান চালিয়ে একটি আবাসিক বাসায় অস্ত্র তৈরির কারখানা আবিষ্কার করে। অভিযানকালে বিদেশি পিস্তল, গুলি, অস্ত্র তৈরির সরঞ্জামসহ মেহেদী হাসান নাদিম (৩৫) ও রাসেল নামে দুজনকে (৩০) গ্রেফতারও করে। জেলা গোয়েন্দা পুলিশ জানায়, মেহেদী হাসান নাদিমের কক্ষে অস্ত্র তৈরির কারখানার সন্ধান পান তারা। অভিযানে ২টি বিদেশি পিস্তল, ৮ রাউন্ড গুলি, বিপুল পরিমাণ অস্ত্র তৈরির সরঞ্জামাদি উদ্ধার করা হয়। পুলিশ ও গোয়েন্দা অভিযানে চলতি বছর নগরী ও শহরতলীর বিভিন্ন স্থান থেকে দেড় শতাধিক আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার হয়েছে, গ্রেফতার হয়েছে প্রায় দুইশ অস্ত্রবাজ সন্ত্রাসী। এত কিছুর পরও অবৈধ অস্ত্রের বেপরোয়া দাপট কমছেই না।

জানা গেছে, বিভাগীয় শহরসহ আশপাশের এলাকায় বেপরোয়াভাবে অস্ত্রশস্ত্রের ঝনঝনানি, বেচাকেনা ও সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর যথেচ্ছ দৌরাত্ম্যে সর্বত্র ভীতিকর অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এদের অনেকে পুলিশের হাতে ধরাও পড়েছে। তখন বেড়িয়ে এসেছে রহস্যময় বড়ভাইদের নাম। যারা অনেকেই রাজনৈতিক দলের নেতা। ময়মনসিংহ নগরী ও শহরতলীর প্রায় প্রতিটি এলাকাতেই অস্ত্রবাজ গ্রুপের অবস্থান রয়েছে। তারা পরস্পর সংঘাত সংঘর্ষে লিপ্ত থাকা ছাড়াও অস্ত্র উঁচিয়ে ছিনতাই-ডাকাতি, চাঁদাবাজি, ভাড়াটে খুন খারাবিতে জড়িত। চিহ্নিত অস্ত্রবাজরা জায়গাজমি জবরদখলের কর্মকাণ্ডেও ভাড়াটে গুণ্ডা হিসেবে কাজ করছে। নগরীর কাচিঝুলীমোড়, ইটাখোলা, আনন্দমোহন কলেজ রোড, টাউনহল মোড়, সানকিপাড়া রেলক্রসিং, জিলা স্কুল মোড় ও এর পেছনের গলি, আকুয়া ভাঙ্গাপুল, বাইপাসমোড়, পুলিশ লাইন, বাকৃবি এলাকা, কেওয়াটখালি, পাটগুদাম ব্রিজমোড়, শম্ভুগঞ্জ এলাকা, কালিবাড়ী, চরপাড়া, মাসকান্দা, ছত্রিশবাড়ী কলোনি এলাকায় অস্ত্রবাজ গ্রুপগুলোর বেপরোয়া দাপট রয়েছে বলে ভুক্তভোগী নাগরিকরা জানিয়েছেন।

সুত্র: বাংলাদেশপ্রতিদিন.

Print Friendly, PDF & Email