এই কালো পাহাড় সরিয়ে আমার স্বাধীনতা দাও
প্রকাশিতঃ ১:১০ পূর্বাহ্ণ | সেপ্টেম্বর ২৩, ২০১৮
অনেকে মন খুলে লিখতে বলেন। অনেকে মন খুলে কথা বলতে বলেন। আমি না পারি হাত খুলে লিখতে না পারি কণ্ঠ ছেড়ে কথা বলতে। কেউ আমার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেনি। তবু আমি পারি না। হাতে কী যেন এক অদৃশ্য রশির বাঁধন। পা যেন কোথায় আটকে আছে। কণ্ঠ যেন কে চেপে ধরেছে! না পারি লিখতে, না পারি বলতে। আমরা সবাই বলি গণমাধ্যম অবাধ স্বাধীনতা ভোগ করছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তাঁর মন্ত্রীরাও বলেন। এটা সত্য, ইলেকট্রনিক মিডিয়ার বিপ্লব ঘটেছে শেখ হাসিনার হাত ধরেই। কত কত বেসরকারি টেলিভিশন তবু দর্শক শুধু রিমোট টেপে। চ্যানেলে চ্যানেলে ঘোরে। আমি এক অজানা আশঙ্কা ও অস্থিরতায় ভুগি। কী এক গরম নিঃশ্বাস ঘাড়ে লাগে। সেলফ সেন্সরশিপ আরোপ করি। বুকের দহন থামাতে পারি না। কোথায় যেন ডরভয়। কী এক গায়েবি শক্তি বাধা হয়ে দাঁড়ায়। আহত পাখির মতো ছটফট করি। ছেলেবেলায় ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখতাম, কে যেন তাড়া করছে। আর ভয়ে দৌড়াতে গেলে ছুটতে পারতাম না। ঘুম ভাঙতেই বুঝতাম দুঃস্বপ্ন। মা দোয়া-দরুদ পড়ে গায়ে হাত বুলিয়ে বলতেন, বোবায় ধরেছে। আমাকে এখন নিয়ত বোবা তাড়া করে। আজকাল অস্থিরতায় ঘুম আসে না। ছটফট করি। সোনার পালঙ্কে ঘুমাতে দিলেন। মনের মতো পোশাক দিলেন। সুস্বাদু সব খাবার দিলেন। সঙ্গিনী হিসেবে হুরপরিও দিলেন। কিন্তু আমার চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা থেকে নিঃশঙ্কচিত্তে বিবেকের তাড়নায় মন খুলে লিখতে দিলেন না। বলতেও দিলেন না। এ যেন সোনার পালঙ্কে শুয়ে থাকা স্বাধীনতাপ্রিয় মানুষের বুকের ওপরে ভারী কালো পাহাড় উঠিয়ে দেওয়া। আমাার তখন দমবন্ধ অবস্থা। দমবন্ধ জীবন শান্তি ও সুখের হয় না। বুক ভরে শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে না পারলে মানুষের যেমন জীবনকে আজাব মনে হয় তেমনি একজন গণমাধ্যমকর্মীকে মন খুলে বলতে ও হাত খুলে লিখতে না দিলে জীবন জাহান্নামের হয়ে ওঠে। স্বগতোক্তির মতো বলতে হয়, এত প্রাণবন্ত আমুদে মানুষ আমি সেলফ সেন্সরশিপের যাতনায় আজ ‘জাহান্নামের আগুনে বসিয়া আমি হাসি পুষ্পের হাসি’। সারা রাত এপাশ-ওপাশ করে কাটাই। ভোরের আলো ফুটতে ফুটতে আজানের সুরেলা ধ্বনি আসে কানে। পাখিরা গান গেয়ে ওঠে। মনে হয়, কত তার সুখ। হাওর বিলে শাপলা-শালুকের মাঝে মাছ ধরা মাঝি সেও বড় সুখী যখন মনের সুখে গান বাঁধে, গান গায়। আমার তখন মনে হয়, বেশি কিছু চাইনি আমি। মাছ-ভাত জীবন চেয়েছিলাম। স্বাধীনচেতা মন নিয়ে সত্য সে যত অপ্রিয় হোক তাই বলব, তাই লিখব ভেবেছিলাম। অবাধ্য দুপুরে একদল কিশোর-কিশোরী যেমন পুকুরে মহা আনন্দে সাঁতার কাটে, যেমন করে মনের সুখে শীষ দেয়, গাছে গাছে পাখিরা নেচে নেচে ওড়ে; তেমনি স্বাধীনতার সুখ নিয়ে আমিও মনপ্রাণ উজাড় করে দুই হাতে লিখতেই চেয়েছি। গলা ছেড়ে বলতে চেয়েছি। এর চেয়ে বেশি কিছু চাইনি আমি। স্বাধীনভাবে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারের পক্ষে উচ্চকণ্ঠে বলতে চেয়েছি। মনের ভাষায় লিখতে চেয়েছি। বুক ভরে শ্বাস নিয়ে আত্মমর্যাদার জীবন লাভ করে বাঁচতে শিখেছিলাম। এই পাঠ আমাদের দিয়েছিলেন জাতির মহত্তম নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। লাখো লাখো শহীদ আর সম্ভ্রমহারা মা-বোনেরা সুমহান মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত সংবিধানে আমাদের বাক ও মত প্রকাশের এই অবাধ স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। মাথা উঁচু করে চলতে শেখার পাঠ সেই মহান নেতা দীর্ঘ সংগ্রামের পথ ধরে দিয়েছিলেন। সততা-সরলতা বিশ্বাসনির্ভর গভীর ভালোবাসার জীবন চেয়েছি। আত্মমর্যাদাবোধ চেয়েছি জীবনের পরতে পরতে। মূল্যবোধ ও আদর্শের সমাজ এবং রাজনীতি, যা পূর্বসূরিরা শিখিয়েছিলেন তা চাইতে কার্পণ্য করিনি। আজকাল সময়ের কাছে প্রতারিত হতে হতে মাঝেমধ্যে নিজেকে বড় বেশি একা, অসহায় মনে হয়। আমাদের তারুণ্যে নেতানেত্রীরা ডাক দিয়েছিলেন গণতন্ত্রের সংগ্রামে। অধিকার আদায়ের উত্তাল রাজপথে আমরা উল্কার মতো নেমেছিলাম। বুকের ভিতর সে কী অমিত সাহস! চোখেমুখে সে কী স্বপ্ন! আহা রে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা ও আইনের শাসনের সে কী অঙ্গীকারনামা। স্বপ্নের ফেরিওয়ালার মতো নেতানেত্রীরা বাগ্মিতায় আমাদের মুগ্ধ করেছিলেন। আমাদের তারুণ্যের রক্ত তখন টগবগ করে ফুটেছে। গণতন্ত্রের সংগ্রামে আমরা কত পথ হেঁটেছি, জেল খেটেছি। কত শত প্রাণ জীবন দিয়েছে। কত সহস্র মানুষ এখনো শরীরে পুলিশের নির্যাতনের চিহ্ন নিয়ে বেঁচে আছে। আমরাও কথা রেখেছিলাম। গণমাধ্যম সেদিন গণতন্ত্রের পাশে সাহসী অবস্থান নিয়েছিল। তবে আমরা কথাই রাখিনি, বিশ্বাসও করেছি। কিন্তু কথা রাখেননি আমাদের নেতানেত্রীরা। বিশ্বাস ভঙ্গ করেছেন ক্ষমতার পালাবদলে ম্যারাথন রেসের মতোন। বলেছিলেন আমরা পথে নামলে সেনাশাসনের অবসান হবে। প্রান্তিক থেকে লাখো সংগ্রামী মানুষ চলো চলো ঢাকা চলো স্লোগান তুলে ছুটে এসেছিল সেদিন। নেতারা বলেছিলেন, সামরিক শাসনের অবসান হলেই সব কালাকানুন বাতিল হবে। দমন-পীড়ন ও অগণতান্ত্রিক শোষণের অবসান হবে। মানুষ ফিরে পাবে তার সব মৌলিক অধিকার। গণমাধ্যম পাবে সংবিধানপ্রদত্ত অবাধ স্বাধীনতা। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নেবে। সুশাসন নিশ্চিত হবে। দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরা হবে। জনগণের শক্তিতে তীব্র গণজোয়ারে ভেসে গেছে সামরিক শাসন। কত শহীদের রক্তে ভেসে যাওয়া সেসব সেনাশাসন! কিন্তু গণতন্ত্রের আটাশ বছরে দুর্নীতিপরায়ণদের উল্লাসনৃত্য কত শত গুণ বেড়ে গেছে। রাজনৈতিক দমন-পীড়ন এক শাসনামল থেকে আরেক শাসনামলে বেড়েছে কয়েক গুণ। রাজনীতির প্রতিহিংসার বিষাক্ত তীরে যন্ত্রণাবিদ্ধ হয়েছে সমাজ। সংসদ কার্যকর হয়নি। গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়নি। নেতারা অঙ্গীকার রাখেননি। সৎ-আদর্শবান মানুষ নির্বাসনে গেছেন। আদর্শহীন নির্লজ্জ মতলববাজ বেহায়ারা সবখানে বড়র মতো হাঁটছে। পেশাদারিত্বের জীবনে নেতা হতে চাইনি। চেয়েছি কেবল কোথাও মাথাটা নত না করতে। তবু পেশাদারিত্বের নামে সাংবাদিকদের দুই দলের দলাদলি, দালালি, চাটুকারি, তদবিরবাজি এবং করুণ দাসত্ব ও বিভক্তি আমাদের শক্তি শেষ তলানিতে নিয়ে গেছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নামে সম্পাদক পরিষদসহ সবার আকুতি উপেক্ষা করে আওয়ামী লীগের মতো গণমুখী রাজনৈতিক দলের সরকার যে কালো আইন সম্প্রতি পাস করেছে তা আমাদের বুকের ওপর দৈত্যের মতো কালো পাহাড়। এ আইন পাসে যেমন সংসদে রাজনীতিবিদরা বিরোধিতা করেননি, সংশোধনী চাননি; তেমনি সাংবাদিকসমাজও ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে নামতে পারেনি। অথচ একদিন এমন কালো আইনের বিরুদ্ধে সরব হতো প্রতিবাদে দেশ! ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনামের মতের আলোকে, গণমাধ্যমের জন্য প্রযোজ্য নয়, এ বিধানটি রাখলে ইলেকট্রনিক ও অনলাইন সাংবাদিকতার স্বাধীনতা খর্ব হতো না। ব্রিটিশ কলোনিয়াল যুগের অফিশিয়াল সিক্রেট অ্যাক্টস প্রবর্তন করে তথ্য অধিকার আইনকে নির্বাসনে পাঠিয়েছে। সংবিধান ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী এই কালো আইন কতটা ভয়ঙ্কর আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে না যাওয়া পর্যন্ত টের পাবে না। দৈত্যের মতো বুকের ওপর চাপানো এই কালো আইন না সরালে বুক ভরে গণমাধ্যম শ্বাস-প্রশ্বাসও নিতে পারবে না। একদিকে আইন করে দুর্নীতির অভিযোগে সরকারি কর্মকর্তাদের ঊর্ধ্বতনের অনুমতি ছাড়া গ্রেফতার না করার ব্যবস্থা করে দুদকের হাত দুর্বল করে দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে ডিজিটাল নিরাপত্তার নামে এই কালো আইন গণমাধ্যমকে বিশেষ করে ইলেকট্রনিক ও অনলাইন সাংবাদিকতাকে প্রাণহীনই করেনি রীতিমতো হাতে-পায়ে বেড়ি পরিয়েছে। বিনা ওয়ারেন্টে পুলিশকে তল্লাশির যে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে সেটিসহ বিভিন্ন ধারার রাজনৈতিক অপপ্রয়োগ অতীতের অনেক আইনের মতো বড় আকারে দেখা দেবে— এ কথা বলাই যায়। গণমাধ্যমসহ সব গণতান্ত্রিক শক্তি সংবিধানপ্রদত্ত বাক ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষায় অভিন্ন কণ্ঠে এখনই বলার সময়— এই কালো পাহাড় সরিয়ে আমার স্বাধীনতা দাও।
লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।
সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন।