|

খুনের বদলা খুন

প্রকাশিতঃ ১০:৫৫ পূর্বাহ্ণ | অক্টোবর ০৯, ২০১৮

মির্জা মেহেদী তমাল: গত ২৪ মার্চ রাতে কুমিল্লায় খুন হলেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা হাজী মনির হোসেন। চার অস্ত্রধারী খুব কাছ থেকে তাকে এলোপাতাড়ি গুলি করে। এতে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু ঘটে। তিতাস উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ও জগতপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি হাজী মনির এভাবে খুন হওয়ার পর আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। হাজী মনির ছিলেন অত্যন্ত প্রভাবশালী ব্যক্তি। নিজ এলাকার রাস্তায় ঘিরে ধরে তাকে হত্যা করাটা যেন অবিশ্বাস্য বিষয় ছিল। কারণ তিনি একা চলাফেরা করতেন না। ঘটনার পর পুলিশ ও গোয়েন্দারা খুনিদের চিহ্নিত করতে মাঠে নেমে পড়ে। সংস্থাগুলো নিজেদের মতো করেই তদন্ত চালায়। হাজী মনিরের পরিবারও খুনের কারণ খুঁজে পায় না। রাজনৈতিকভাবে তার প্রতিপক্ষ ছিল। কিন্তু খুন-খারাবি করার মতো কোনো শত্রুতা সাম্প্র্রতিক সময়ে কিছু ঘটেনি বলে হাজী মনিরের পরিবার পুলিশকে জানায়। পরদিন মনিরের ছেলে আইনজীবী মুক্তার হোসেন নাঈম বাদী হয়ে তিতাস থানায় মামলা করেন। ওই মামলায় জগতপুর ইউনিয়ন পরিষদের দুই নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক মেম্বার জাহাঙ্গীর আলম ও তিন নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক মেম্বার কাজী আশেক, নবীর হোসেনসহ ১৮ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা আরও ১৫ জনকে আসামি করা হয়। পুলিশ তদন্ত শুরু করে। কিন্তু পুলিশের কাজে গতি না থাকায় জেলা পুলিশ সুপারের নির্দেশে মামলাটি গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) ওপর হস্তান্তর হয়। ডিবি আসামি ধরতে অভিযান চালায়।

ডিবি পুলিশ একই উপজেলার ভাটিপাড়া গ্রামের মৃত আবদুল্লাহর ছেলে নবীর হোসেনকে গ্রেফতার করে। এই নবীর হোসেন এজাহারভুক্ত আসামি। পুলিশ তাকে জেরা করে। জেরার মুখে নবীর জবানীতে বেরিয়ে আসে একজন নারীর নাম। গোয়েন্দারা নড়েচড়ে বসেন। নিবিড়ভাবে জেরা শুরু হয় পদস্থ কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে। নবীর হোসেন পুলিশকে বলেন, একই এলাকার বিলকিস আক্তার এই খুনের ঘটনাটি ঘটিয়েছে। বিলকিস তার আপন ফুফু। ১৬ বছর আগে একই এলাকায় খুন হয়েছিলেন তার ফুফা মোশতাক। ফুফু বিলকিস আক্তার বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেন। স্বামীর খুনি হিসেবে হাজী মনিরকে আসামি করেছিলেন বিলকিস। কিন্তু পুলিশ হাজী মনিরকে গ্রেফতারে কোনো ব্যবস্থাই নেয় না। বরং মনির প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াতে থাকে। বিলকিস বেগম তার স্বামী মোশতাকের খুনিদের গ্রেফতারের দাবি নিয়ে ঘুরতে থাকেন এক অফিস থেকে আরেক অফিস। যে যেখানে আশ্বাস দিয়েছেন, সেখানেই গেছেন। ঢাকায় এসে ঘোরাঘুরি করেছেন। কিন্তু স্বামী হত্যার বিচার পাননি। হাজী মনির হোসেন এলাকায় অত্যন্ত প্রভাবশালী একজন ব্যক্তি। তার কথাতেই তখন সব হতো। যে কারণে পুলিশ তাকে ঘাঁটাত না। এদিকে স্বামীর খুনিরা গ্রেফতার না হওয়ায় মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন বিলকিস। স্বামী হারানোর কষ্ট বেড়ে যায় কয়েক গুণ বেশি, যখন জানতে পারেন খুনিরা সব ঘুরে বেড়াচ্ছে। হতাশ বিলকিস। ভাবতে পারছেন না, কী করবেন তিনি। দিন যায়, সপ্তাহ ঘুরে মাস যায়। আসামি গ্রেফতার হয় না। বিলকিস আক্তারও এর পিছু ছাড়ে না। এভাবেই বছর কাটে। বিলকিস আক্তারের কষ্টটা হঠাৎ ক্রোধে পরিণত হতে থাকে। খুনিকে গ্রেফতারের বিষয়টি মাথা থেকে সরিয়ে ফেলেন। বছর যায়। আসে নতুন বছর। মানুষও ভুলতে শুরু করেছে মোশতাক খুনের ঘটনা। ভুলতে পারে না শুধু মোশতাকের পরিবার। যে পরিবারের ক্ষতিটা হয়েছে অপূরণীয়। বিলকিস আক্তার পুলিশের ওপর থেকে আস্থা হারান। তিনি নিশ্চিত হয়ে পড়েন, খুনিদের গ্রেফতার করবে না পুলিশ। যা করার নিজেকেই করতে হবে। তিনি ভাবেন, খুনের বদলা খুন। এ ছাড়া অন্য কোনো পথ নেই। তিনি হাজী মনিরকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়ার চিন্তা করেন। আর এই চিন্তাটা নিয়ে কথা বলেন নবীর হোসেনের সঙ্গে। নবীর হোসেনসহ আরও কয়েকজন দীর্ঘদিন ধরেই মোশতাককে হত্যার চেষ্টা চালায়। কিন্তু ঠিক মতো নিশানায় পাওয়া যায়নি তাকে। মরিয়া হয়ে ওঠা বিলকিস আর কোনো অজুহাত শুনতে চায় না। তার এক কথা, খুনের বদলা খুন। আর এ জন্য বিলকিস নিজেই চারজন ভাড়াটে খুনি নিয়ে আসে এলাকায়। তারা বিভিন্ন সময়ে হাজী মনিরের পথে আড়ালে আবডালে ঘাপটি মেরে থাকত। কিন্তু সুযোগ-সুবিধা না পাওয়ায় খুন করতে পারেনি। অবশেষে দীর্ঘ ১৬ বছর পর তারা পেয়ে যায় সেই সুযোগটি। ঘিরে ধরেই গুলি চালায় মনির হোসেনকে। মারা যান তিনি সেই রাতেই। ঘটনার অদূরেই দাঁড়িয়ে পর্যবেক্ষণ করছিলেন নবীর হোসেন। পুলিশ গ্রেফতার করে বিলকিস আক্তারকে। বিলকিস বলেছে, ‘তার স্বামী হত্যার বিচার না পেয়ে খুনিকেই খুন করে প্রতিশোধ নিয়েছি।’ গ্রেফতারকৃত নবীর হোসেন ইতিমধ্যেই ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে চলতি বছরের মার্চে জেলার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বিপ্লব চন্দ্র দেবনাথের আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একটি খুনের মামলার আসামিকে পুলিশ গ্রেফতার না করায় আরও একটি খুনের প্লট তৈরি হয়ে যায়। খুনের মধ্য দিয়ে একটি পরিবারে যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়, তা একমাত্র সেই পরিবারটি অনুধাবন করতে পারে। সেই ক্ষত কখনোই মুছে যাওয়ার নয়। প্রিয় মানুষের অনুপস্থিতি প্রতিনিয়ত পীড়া দিতে থাকে। আর প্রিয়জনের খুনি যখন প্রকাশ্যে ঘোরাফেরা করে তখন মানুষের হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। যে কারণে খুনি বা অপরাধী যত বড়ই হোক না কেন, সমাজের প্রভাবশালী হোক না কেন তাদের আইনের আওতায় আনতেই হবে। নয়তো পুলিশের ওপর মানুষের আস্থা কমবে। কুমিল্লায় খুনের বদলা খুনের এই ঘটনাটি ঘটেছে এ কারণেই। ১৬ বছর পেরিয়ে গেলেও খুন করেই খুনের বদলা নিল বিলকিস আক্তার। যে কারণে তিনি এখন চার দেওয়ালে বন্দী। হাজী মনিরকেও হারাল তার পরিবার।

সুত্র: বাংলাদেশপ্রতিদিন।

Print Friendly, PDF & Email