|

বিএনপির নতুন মুরব্বি কী জাদু দেখাবেন?

প্রকাশিতঃ ১০:১২ পূর্বাহ্ণ | অক্টোবর ১৭, ২০১৮

মেজর জিল্লুর রহমান (অব.): নির্বাচন নিয়ে জাতিসংঘের ব্যালকনিতে চোখ ডলাডলি করে লাল করে করুণ সুরে ফুঁপিয়ে নালিশ করবে, কমনওয়েলথ, কূটনীতিকপাড়া গরম করবে, বড়দার কাছারি ঘরে দেনদরবার করবে, দৌড়ঝাঁপ করবে, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন চাইবে এটাই আওয়ামী লীগ সরকার প্রথম প্রহরে ডায়াগনসিস করে বিএনপির ব্যবস্থাপত্র দিয়েছে।

সিইসি মনোনয়নের গোড়ায় সরকার বিএনপির জন্য একটা ফাঁদ পাতে। রাষ্ট্রপতি, অনুসন্ধান কমিটি, প্রেস ব্রিফিং, পরামর্শের চাটুকার বেহুদা আলাপে বিএনপি সরকারের পাতা ফাঁদেই পা ফেলল। এখন যতই টানাটানি করছে ফাঁদের রশির গিঁট আরও টাইট হচ্ছে।

সাতসকালে বিএনপির এক দাবি ছিল নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার। তা না হওয়ায় গত সংসদ নির্বাচন তারা বয়কট করল। সরকার তাদের সে আশার গুড়ে বালি দিয়ে সেই সুযোগ সংবিধানেও রাখেনি। তত্ত্বাবধায়ক বা নির্বাচকালীন সরকার যদি না থাকে তাহলে নির্বাচন কমিশন পীর-মুরশিদদের দিয়ে গঠিত হলো না তল্পিবাহক হলো, তাতে বিএনপির ফায়দাটা কী?

হলফ করে বলা যায়, নির্দলীয় সরকার ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। তাহলে কোজাক মার্কা সিইসি বাদ দিয়ে ফেরেশতাসম সিইসি বসালে বিএনপি কি শারাবান তহুরা পাবে? বিএনপি তো সরকার রচিত রম্য নাটকের নির্ধারিত চরিত্রের পাঠ হুবহু মঞ্চস্থ করে তালিয়া পাচ্ছে।

বিএনপির নেতা-নেত্রীর বন্দনা করা যদি অহর্নিশি একমাত্র রাজনীতি হয়, পরিণতি যা হওয়ার তাই হচ্ছে। অফিসে হাজিরা দেওয়া আর বদন দর্শনের ফজিলতে কি আমজনতাকে মাঠে আনা যাবে?

বিএনপি নয়া বণিকদের নেতা পয়দা করার কারখানা চালু করেছে। যাদের জনগণের সঙ্গে, রাজনীতির সঙ্গে জš§সূত্রে কোনো সংশ্রব নেই, হামলা-মামলার শিকার হওয়ার নজির নেই, জনতার দুর্দিনে প্রতিবাদে পুলিশের পিটুনি খায়নি, হয়রানির শিকার হয়নি। নিজের পকেট খালি করে কারও ঋণের টাকা শোধ করেনি। শেষ সম্বল জমি বিক্রি করে কর্মীকে জেল থেকে বের করেনি। স্বার্থপররা মাতব্বরি করুক এই দলে আওয়ামী লীগ তাই চায়।

আমার নিজ জেলা বাগেরহাটের রামপাল উপজেলার নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের অনটনের সংসার চলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন প্রয়াত ওহাব ইজারাদার। চারদলীয় জোট ক্ষমতায় থাকাকালে তার প্রায় সব কর্মীর নামে মামলা ছিল। একটা নিবেদিত যুব কর্মীর নামে মামলায় সেই কর্মী গ্রেফতারও হয়। খবর পেয়ে তিনি পুরনো ময়লা তেলচিটে পড়া পাঞ্জাবি পরে অন্য এক কর্মীকে ডেকে বলেছিলেন, ‘আমার ১০ কাঠা জমি আছে দ্রুত বিক্রি করে ওকে জেল থেকে বের করে আনো।’

তার বিত্ত ছিল না আত্মা ছিল, কর্মীর প্রতি অগাধ দরদ ছিল। বিএনপিতে অর্থপাতি আছে কিন্তু এমন কর্মীর পিতৃতুল্য নেতা কজন আছেন? পোশাক-আশাকে, চলনে-বলনে, আচার-আচরণে সবাইকে লর্ড ক্লাইভের উত্তরসূরি মনে হয়। কোন আদর্শের, চেতনার ধারকবাহক ভাবা মুশকিল। বিএনপি সব গতানুগতিক জীবনধারায় আবর্তিত। আন্দোলনের জাতীয় কত ইস্যু ছিলÑ দিনকানা হয়ে তারা দেখতে পায়নি। ভদ্রলোক আনু মুহাম্মদ পুলিশের মার খেয়ে হাত-পা ভেঙে ও মাগো! ও বাবাগো! বলে পক্ষকাল হাসপাতালে কাতরালেন। আর সেই সময় বিএনপি চোখে ঠুলি লাগিয়ে তাপানুকূল কোনো বদ্ধ ঘরে বসে সাহিত্য রচনায় মশগুল ছিল। কবি-সাহিত্যিক হওয়ারই যখন এত ইচ্ছা তখন জনগণকে সুড়সুড়ি দিয়ে ইয়ার্কি মারার দরকার কী? রমনা বটমূলে, ছায়ানটে গেলে সুবিধা হবে নাম কামাতে। একটা শক্ত দেয়াল ভাঙতে গেলে শক্তিশালী ধাক্কা লাগে কথাটা তাদের মনে রাখা দরকার।

অঢেল সম্পদ আছে অনেকের। বিএনপি শিবিরে নয়া আশাবাদী উদীয়মান বণিক নেতাদের পিছে কজন বেকার ঘোরে, তাই কিছু উচ্ছিষ্ট দিয়ে তাদের অনুগত রাখাকে কি রাজনীতি বলে? কর্মীবান্ধব নেতা বলে? তাদের কিছু এজেন্ট দিয়ে ফেসবুকিং করে হাইকমান্ডকে দেখাতে চায় তাদের গোলাভর্তি ভক্ত-অনুসারী আছে, কত যে জনপ্রিয় আহা কি ভুল না করছে বেচারা! কর্মীরাও চালাকচতুর দুই পয়সা হাতিয়ে নিতে আসে, জেল খাটতে আসে না। নেতা-কর্মী যত দিন মানসিক মায়ামমতায় একাকার না হবে তত দিন লৌকিকতা চলবে, ত্যাগ-তিতিক্ষা আসবে না। এরা দিবা বিএনপি, নিশিতে সংগোপনে গাড়ি ভরে উপঢৌকন নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতার বারান্দায় ধরনা দেয়। লুকিয়ে সওদাগিরি আলাপচারিতা করে। মামলা থেকে বাঁচতে ইয়া নফসি ইয়া নফসি নিজ পিঠ বাঁচাতে পিতলের পিরিতি আলাপ করে, এই কায়কারবার এখন ওপেন সিক্রেট, কর্মীরাও জেনে গেছে। শ্রীমানদের ত্রিশঙ্কু ব্রত বগলে নিয়ে বিএনপিকে সরকারের পাতা ফাঁদ থেকে উদ্ধার করা ছেলের হাতের মোয়া নয়।

১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর বিএনপির ত্যাগী, দলীয় আদর্শিক, রাজপথের লড়াকু রাজনীতিক, সাহসী নেতা তরিকুল ইসলামকে দেখেছি। গুলিস্তানে স্বৈরাচার পতন দিবসে দুই বড় দলের জনসভা ছিল। বিএনপি দক্ষিণ দিক, আওয়ামী লীগ বায়তুল মোকাররমের দিকে সভা করছিল। দুই দলের মারামারি বেধে হাঙ্গামায় দুই জনসভার লাখো মানুষ একাকার হয়ে যায়। দোকানে আগুন, পুলিশের গাড়িতে আগুন। উত্তর দিক থেকে দক্ষিণে জনতা ছুটে হামলে পড়ে বিএনপির সমর্থকদের ওপর। বিএনপির মঞ্চের কাছে আওয়াজ তোলে ভাঙ, আগুন লাগা। গুলি, লাটিচার্জ, টিয়ার গ্যাসে চোখ খুলে রাখা যায় না। গুলিস্তান পুরোদস্তুর রণক্ষেত্র।

দেখলাম ভয়ঙ্কর অবস্থার মধ্যে কর্মীদের বাঁচাতে কোন দুঃসাহসে তরিকুল ইসলাম পরিস্থিতি আয়ত্তে নিলেন। তিনি দুই হাত দিয়ে দলীয় লোক ডাক দিয়ে স্লে­াগান দিতে দিতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মারমুখী বিরোধীদলীয় অগণিত মানুষের ভিতর কয়েকজন কর্মীর মিছিল নিয়ে ঢুকে পড়লেন। কী সাংঘাতিক সাহস! ভরা যৌবনের কাউকে সামনে দেখলাম না। কিছু সাহসী ছাত্রদল নেতানেত্রী তাকে ঘিরে পেছনে অনুসরণ করে এগিয়ে চলল। তাকে নিরাপদে বেষ্টনী করে রাখল। কর্মীদের শান্ত থাকার আহ্বান জানালেন, কোনো ভয় নেই, আমি এখানে আছি, জীবন থাকতে রাজপথ ছাড়ব না। সেদিন রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে আসন্ন দাঙ্গা সামাল দিলেন। কর্মীদের বিপদমুক্ত করলেন।

পদপদবি পাওয়ার সুড়সুড় করা লোকের অভাব নেই। যত দিন এসব দুঃসময়ের সাহসী কান্ডারির মূল্যায়ন হবে না তত দিন দল কূলকিনারা পাবে না।

নয়া পয়সার মালিক ব্যস্ত তার সম্পদের অস্তিত্ব রক্ষার নিরাপদ রুট খুঁজতে। রাজনীতিক রেডি থাকবে জেলে যেতে মরিয়া থাকবে আদর্শের লড়াই করতে। আরাম-আয়েশি জীবনে অভ্যস্তরা গরিবের দুঃখ বোঝে না। অভাবীর প্রতি করুণা করে, দায়িত্ব পালন করে না। ধনী টাকা দেয় সালাম পাওয়ার জন্য। দল করতে আসে নেতা হতে। কোনো আদর্শে উদ্বুদ্ধ এরা নয়। ব্রত শুধু টাকা কামানো। রাতারাতি টাকা বানানো আর মেধা-মনন দিয়ে আদর্শের টানে ময়দানে লড়াই করা এক নয়। রাজনীতি ত্যাগের মহাসমুদ্র। বিএনপি আবদার, আবেদন-নিবেদন, আহ্বান কুলিয়ে উঠতে পারছে না, বড় কারণ ময়দানে নেতারা নেই। কেউ উদ্যোগী হয়ে কিছু তাদের জন্য করে দেবে এ আশায় বুক বেঁধে আছে। এ তো ডাহা হায়েনার চরিত্র নিজে শিকার করার মুরোদ নেই, সহজলভ্য অন্যের শিকার ভক্ষণ করে। ক্রিয়া করতে হলে মেধা-মনন শক্তির মিলন লাগে। অন্যথা শুধু প্রতিক্রিয়া করতে হয়। বিএনপি তাই করে যাচ্ছে।

আজ অবধি তাদের মূল দাবি শনাক্ত হয়েছে বলে মনে হচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন তারা চায় কী তারা নিজেরাই জানে না। সিইসি কে হবেন না হবেন তা নিয়ে সরকার পরিকল্পিত হুলুস্থূল বাধিয়ে ঢাকঢোল পিটিয়ে, বঙ্গভবনের উষ্ণ আতিথেয়তা, ন্যায়পরায়ণ অনুসন্ধান কমিটি করে বিএনপির কথা মাটিচাপা দিয়ে ফেলল। সরকার ছেলে ভোলানোর মতো সব করে গেল। সুকৌশলে অবান্তর বিষয়ে আটকে রাখার এই সরকারি রাজনৈতিক কৌশলের কাছে বিএনপি গোহারা হেরেছে। এখনো হুঁশ ফিরে আসেনি দলটির।

অভিজ্ঞতা বলে, সুষ্ঠু নির্বাচন নির্ভর করে নির্বাচনকালীন সরকারের ওপর। দলীয় সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সম্ভাবনা আদতেই কম নেই। আশির দশক থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশে দলীয় সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনকেই আমজনতা, পর্যবেক্ষক, বিরোধীপক্ষ সুষ্ঠু বলে মেনে নেয়নি। ভবিষ্যতেও সেই ধারাবাহিকতার ঐতিহ্য বজায় থাকবে ইনশা আল্লাহ। তা যদি হয়, তাহলে সিইসি মনোনয়নের খেলায় বিএনপির কিছু পাওয়া দূরে থাক, বরং অনেক কিছুই হারিয়েছে।

এখন তাদের সামনে পথÑ হয় এই সরকারের অধীনে নির্বাচন না করা, অথবা এই সরকারের অধীনে মুখ রক্ষার সরকারের কর্তৃত্ব মেনেই নির্বাচনে দাঁড়ানো। মোক্ষম পথ আন্দোলন। বাংলাদেশের ইতিহাস বলে, বড় গণআন্দোলন ছাড়া সুষ্ঠু কোনো নির্বাচন এ দেশে হয়নি। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের হাত ধরে চুয়ান্নর নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয়, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ছিনিয়ে আনে সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়। নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের পরের নির্বাচনে বিএনপির বিজয়। ছিয়ানব্বইয়ের গণআন্দোলনের পর আওয়ামী লীগের বিজয় এর প্রমাণ। ১/১১ জরুরি অবস্থার আগেও আওয়ামী লীগের আন্দোলনের কারণেই বিএনপিকে ক্ষমতা ছাড়তে হয়েছিল। সেই আন্দোলনসহ জরুরি অবস্থার সময়ের ছাত্র আন্দোলনের সুফল আওয়ামী লীগের ঘরেই গিয়েছিল ২০০৮-এর নির্বাচনে। নব্বইয়ের পরের এসব আন্দোলনে যে দল জয়ী হয়েছে, তাদের দাবি মোতাবেকই তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়েছে। সেটাই তাদের নির্বাচনী বিজয়ের জন্য অনুকূল ও ‘নিরপেক্ষ’ পরিবেশ দিয়েছে। গণআন্দোলন ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচনও যেমন হওয়ার নয়, তেমনি আন্দোলন ছাড়া বিএনপির পক্ষেও আবার ক্ষমতায় যাওয়া সহজ নয়। বিএনপি নিজের অস্তিস্ত রক্ষায় ড. কামালের নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট গঠন করেছে। এ ফ্রন্ট বড় কোনো আন্দোলনের পরিবেশ তৈরির বাহুবল কতটুকু রাখে তা দেখার বিষয়। ড. কামালের মতো মুরব্বিরা আদৌ কোনো জাদু দেখাতে পারেন কিনা বিবেচ্য বিষয়।

লেখক : নিরাপত্তা বিশ্লে­ষক

সুত্র: বাংলাদেশপ্রতিদিন।

Print Friendly, PDF & Email