|

দুর্ঘটনা নয়, পরিকল্পিত খুন

প্রকাশিতঃ ১০:১৯ পূর্বাহ্ণ | অক্টোবর ১৭, ২০১৮

মির্জা মেহেদী তমাল: কলেজ ছুটি। তাই বাবা মায়ের কাছে গ্রামে ফিরেছে নয়ন। থাকবে কিছুদিন। এক সকালে বাসা থেকে বেরিয়ে যায় নয়ন। কিন্তু সন্ধ্যাতেও না ফেরায় বাবা মা ভীষণ টেনশনে। বন্ধুদের কাছে খোঁজ করেন। কিন্তু কেউ নয়নের খোঁজ জানে না। কেউ বলছে কলেজে ফিরে যেতে পারে। কিন্তু সেখানেও যায়নি। সঠিক জবাব মিলে না কারও কাছে। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়, ফিরে না নয়ন। অবশেষে তারা থানা পুলিশের কাছে যায়। পুলিশ জানায়, হাসপাতালে খবর নিন। ট্রেনে কাটা একটা লাশ আছে। সেই লাশটিও দেখতে পারেন। পুলিশের মুখে এমন কথা শুনে নয়নের বাবার বুক কাঁপে। বলে কি পুলিশ কর্মকর্তা! তিনি পুলিশকে বলেন, কী বলেন। ট্রেনে কাটা লাশ কেন দেখতে যাব। পুলিশ আশ্বস্ত করে নয়নের বাবাকে। বলেন, নয়নের লাশ ওটা, তা বলছি না। যেহেতু ছেলেকে পাচ্ছেন না, একই বয়সের এক ছেলের ট্রেনে কাটা লাশ উদ্ধার হয়েছে, তাই দেখতে বলেছি। নয়নের বাবা মনে অজানা আশঙ্কা নিয়ে হাসপাতালের মর্গে যান। লাশ ঘরের লোককে ডেকে আনেন। রাতের আঁধারে লাশ ঘরের দরজা খুলে দেয় ডোম। লাইট জ্বালানো হয়। মেঝেতে পড়ে আছে লাশ। মাথা আলাদা। শরীরও খণ্ডিত। তাকানো যায় না। নয়নের বাবা নিশ্চিত-এটা তার সন্তানের লাশ নয়। নাকে রুমাল চেপে ঘরের ভিতর ঢুকেই মাথাটা ভালো করে পরখ করে নিচ্ছেন। আরে এই তো আমার নয়ন! চিৎকার দিয়ে ওঠেন। শুকিয়ে যাওয়া রক্ত শরীরে। সেই শরীর জড়িয়ে ধরে আহাজারি করতে থাকেন পুত্রহারা বাবা। গাইবান্ধা সরকারি কলেজের অনার্স তৃতীয় বর্ষের ছাত্র নয়নের মৃত্যুর ঘটনা এটা। ঘটেছে ২০১৪ সালে। রংপুরের পীরগাছা উপজেলার সোনারায় গ্রামের রফিকুল ইসলামের ছেলে নয়ন। ট্রেনে কাটা পড়ে তার অকাল মৃত্যু হয়। ছেলেকে হারিয়ে বাবা রফিকুল ইসলাম পাগলপ্রায়। কিন্তু ছেলের এই মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না রফিকুল ইসলাম। তার বদ্ধ ধারণা তার ছেলেকে খুন করা হয়েছে। কিন্তু এর পক্ষে কোনো তথ্য-প্রমাণ পান না তিনি। এরপরেও এ ঘটনায় রফিকুল ইসলাম বাদী হয়ে ২০১৪ সালের ১৪ এপ্রিল ছয়জনকে আসামি করে বোনারপাড়া রেলওয়ে থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলাটি প্রথমে বোনারপাড়া রেলওয়ে পুলিশ, পরে সিআইডি এবং সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম তদন্ত করে। তাদের তদন্তে খুনের বিষয়ে কিছুই পায় না। তদন্ত শেষে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে সিআইডি। কিন্তু রফিকুল ইসলাম এর বিরুদ্ধে নারাজি দিয়ে রাখেন।

ঘটনার পর পেরিয়ে গেছে প্রায় সাড়ে তিন বছর। ভুলে গেছে সবাই নয়নের ঘটনা। সবাই নিশ্চিত হয়, ট্রেনে কাটা পড়েই তার মৃত্যু হয়েছে। তবে, সত্য চাপা থাকে না। তা বেরিয়ে আসে একদিন। এর প্রমাণ মিলেছে নয়নের মৃত্যু দিয়ে।

শেষ হয়ে যাওয়া এই ঘটনার নতুন করে তদন্ত শুরু করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। বেরিয়ে আসে আসল রহস্য। প্রমাণিত হয়, ট্রেনে কাটা নয়, খুন হয়েছিল নয়ন। পিবিআইর তদন্তে জানা যায়, নয়নকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছিল। এ কলেজছাত্রকে নৃশংসভাবে হত্যার পর ঘটনাটি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে রেললাইনে লাশ রেখে দেওয়া হয়। পরে ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যু হয়েছে বলে প্রচার চালায় হত্যাকারীরা।

বাদীর নারাজির পরিপ্রেক্ষিতে আদালত মামলাটি পিবিআই রংপুর জেলাকে তদন্তের নির্দেশ দেয়। তদন্তভার পেয়ে তদন্তকারী কর্মকর্তা পুলিশ পরিদর্শক হোসেন আলী এজাহারভুক্ত আসামি জুয়েলকে গ্রেফতার করে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সে দোষ স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। পাশাপাশি অন্য আসামিদের নামও প্রকাশ করে। তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই পরদিন অপর আসামি তুষারকে গ্রেফতার করা হয়।

তদন্ত সূত্র জানায়, নিহত নয়নের সঙ্গে একই থানার তাম্বুলপুর ফকিরপাড়া গ্রামের জলিল ফকিরের মেয়ে রুনির প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। বিষয়টি মেয়ের পরিবার মেনে নিতে পারেনি। তাই ঘটনার বেশ কিছুদিন আগে থেকে আসামিরা নয়নকে বিভিন্নভাবে হুমকি দিয়ে আসছিল। ২০১৪ সালের ৬ এপ্রিল নয়ন ছুটিতে বাড়িতে আসে। ওইদিন রাত আনুমানিক সাড়ে ১০টায় প্রেমিকা রুনি মোবাইলে নয়নকে তার বাড়িতে আসতে বলে। পরে সে বন্ধু তুষারকে নিয়ে তাদের বাড়িতে যায়। যাওয়ার পর জুয়েলসহ অন্য আসামিরা তাদের দেখতে পেয়ে নয়নকে আটক করে এবং অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে রুনির বাড়ি থেকে একটু দূরে নিয়ে যায়। সেখানেই তাকে গলা কেটে হত্যা করে আসামিরা। ঘটনাটি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে লাশ রেললাইনে ফেলে রাখে এবং ট্রেনে কাটা নিশ্চিত করে সবাই বাড়ি চলে যায়। পিবিআইর কর্মকর্তাদের আন্তরিকতায় বেরিয়ে আসে নয়ন মৃত্যুর প্রকৃত রহস্য। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের বিভিন্ন এলাকার রেল লাইনে কাটা পড়ে অসংখ্য মানুষের মৃত্যু হয়। কিন্তু সঠিক তদন্ত না হওয়ায় কোনটা দুর্ঘটনা আর কোনটা পরিকল্পিত খুন তা আর বের হয় না। নয়নকে পরিকল্পিতভাবে হত্যার পর লাশ রেললাইনে ফেলে রাখা হয়েছিল। পুলিশ সিআইডির তদন্তেও খুনের কোনো কিছু খুঁজে পাওয়া যায়নি। খুনিরা রক্ষা পেয়ে যায়। কিন্তু পিবিআইর তদন্তে ভিন্ন তথ্য বেরিয়ে আসে। পিবিআইর তদন্ত না হলে হয়তো নয়নকে খুন করা হয়েছে, তা কখনো কেউ জানতে পারত না। খুনিরাও রক্ষা পেয়ে যেত। যে কারণে পুলিশের তদন্ত সঠিকভাবেই করা প্রয়োজন বলে মনে করেন অপরাধ বিশ্লেষকরা।

সুত্র: বাংলাদেশপ্রতিদিন।

Print Friendly, PDF & Email