|

ফুলটাইম প্রতারণা

প্রকাশিতঃ ৫:১০ অপরাহ্ণ | নভেম্বর ০৬, ২০১৮

মির্জা মেহেদী তমাল: ‘পার্টটাইম চাকরি। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অর্থ ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের স্বীকৃতিপ্রাপ্ত গ্রুপ অব কোম্পানিতে সম্পূর্ণ অফিশিয়াল কার্যক্রম পরিচালনার জন্য কিছুসংখ্যক পুরুষ/মহিলা, ছাত্রছাত্রী আবশ্যক। সপ্তাহে তিন দিন, তিন ঘণ্টা। বেতন ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা। ছাত্রছাত্রীদের অগ্রাধিকার।’

রাজধানীজুড়ে সবখানেই চোখে পড়ে এ ধরনের আকর্ষণীয় চাকরির বিজ্ঞাপন। বাস থেকে শুরু করে নগরের অলিগলি-সবখানে। আর বিজ্ঞাপন দেখে প্রতারিত হচ্ছেন অনেকে। পার্টটাইম চাকরি করার নামে সেখানে চলে ফুলটাইম প্রতারণা। বিশেষ করে ঢাকায় নতুন আসা শিক্ষার্থীরা পড়ালেখার পাশাপাশি টাকা আয়ের উৎস খুঁজতে গিয়ে এসব প্রতারণার ফাঁদে পড়ছেন।

এ ধরনের একটি বিজ্ঞাপনে দেওয়া মোবাইল নম্বর দেখে চাকরির জন্য যোগাযোগ করেন হিমেল। তাকে ফার্মগেট বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে ফোন করতে বলা হয়। সেখানে গিয়ে যোগাযোগ করলে তেজতুরিবাজারের একটি ভবনের চতুর্থ তলায় ‘কবির সাহেবের’ খোঁজ করতে বলেন। সেখানে গিয়ে হিমেল দেখতে পান, সাইনবোর্ডবিহীন একটি অফিস। সেখানে একজন নিজেকে কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে বলেন, চাকরি করতে হলে প্রথমে সাক্ষাৎকার দিতে হবে। পদ হবে সহকারী ব্যবস্থাপকের। যারা অফিসে আসেন, তাদের কাজ বোঝানোই কাজ। বেতন পাঁচ হাজার টাকা। সাক্ষাৎকারে উত্তীর্ণ হলে ৫১৫ টাকা দিয়ে নিবন্ধন করতে হবে। টাকা সঙ্গে না থাকলে সাক্ষাৎকার নেওয়া হবে না। এরপর দুই দিনের প্রশিক্ষণ। এজন্য দিতে হবে আরও দুই হাজার টাকা। প্রশিক্ষণের পর একটি বীমা সংগ্রহ করে দিতে হবে। তারপর চাকরি। আর তা না পারলে চাকরিও হবে না। কোনো টাকাও ফেরত দেওয়া হবে না। ৫১৫ টাকা কেন জানতে চাইলে তিনি জানান, কোম্পানির পক্ষ থেকে পরিচয়পত্র, আইডি কার্ড দেওয়া ও নিবন্ধনের জন্য এই টাকা। আর বাকি টাকা প্রশিক্ষণের জন্য। হিমেল টাকা না দিয়ে চলে এসেছেন। কিন্তু অনেকেই সেখানে টাকা দিয়ে ধরা খেয়েছেন। পরে ওই অফিস আর সেখানে খুঁজে পাওয়া যায়নি।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএর ছাত্র কবির জানান, ফার্মগেট আনন্দ সিনেমা হলের পাশে রাস্তার দেয়ালে খণ্ডকালীন চাকরির একটি বিজ্ঞাপনে শুধু একটি মোবাইল নম্বর দেওয়া ছিল। যোগাযোগ করলে পরদিন ফার্মগেটের মালেক টাওয়ারের নবম তলায় গিয়ে যোগাযোগ করতে বলা হয়। সেখানে গিয়ে তিনি কোনো প্রতিষ্ঠানের নামফলক পাননি। অভ্যর্থনা কক্ষে থাকা একজন তাকে জানান, তিনি ঠিক জায়গায় এসেছেন। এরপর একজন নিজেকে ফয়সাল বাদশা পরিচয় দিয়ে মৌখিক পরীক্ষা দিতে বলেন। টিকলে তবেই চাকরি। বেতন সাড়ে তিন হাজার টাকা। সাক্ষাৎকারের পর বিবেচিত হলেন কবির। কী চাকরি জানতে চাইলে তাকে জানানো হয়, গ্রাহকদের সঙ্গে কথা বলা ও সদস্য বাড়ানো। আর এজন্য বেশ কিছু বিজ্ঞাপন নগরের বিভিন্ন জায়গায় লাগাতে হবে। অফিসে সময় দিতে হবে সপ্তাহে তিন দিন তিন ঘণ্টা করে। তবে এর আগে ৫১০ টাকা দিয়ে নিবন্ধন করতে হবে। টাকা না থাকার কথা জানালে ১০০ টাকা অগ্রিম দিতে বলা হয়। তখন কবির প্রতারণা বুঝতে পেরে পালিয়ে আসেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের ছাত্র তালেব জানান, তিনিও মালেক টাওয়ারেই এরকম ফাঁদে পড়েছিলেন। চাকরি পাওয়ার আশায় তাদের কথামতো ২৫০ টাকা দিয়েছিলেন। এরপর গিয়ে যাকে টাকা দিয়েছেন, তাকে আর পাননি।

বর্তমানে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় যে চাকরির লোভনীয় প্রস্তাব পাওয়া যায় সেটা হচ্ছে মোবাইল টাওয়ারের চাকরি। পুলিশ বলছে, এটা শতভাগ বানোয়াট এবং ভুয়া। কেউ এর খপ্পরে পড়বেন না। ওই বিজ্ঞাপনে একাধিক সাধারণ মোবাইল নম্বর দেওয়া থাকে- অন্য প্রান্ত থেকে সুমিষ্টভাষী মহিলা ফোন রিসিভ করে থাকেন। এক পর্যায়ে তারা প্রশিক্ষণ এবং পোশাক বাবদ টাকা পাঠাতে বলেন। তারপর সব শেষ।

পত্রিকায় চাকরির নামে ভুয়া বিজ্ঞাপন দিয়ে চাকরিপ্রত্যাশীদের কাছ থেকে প্রায় ২০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা এমন একটি প্রতারক চক্রের ১৪ সদস্যকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। রাজধানীর পল্লবী থেকে তাদের গ্রেফতার করা হয়। র‌্যাব জানায়, দেশের বিভিন্ন জেলার চাকরিপ্রত্যাশী বেকার যুবক-যুবতীরা তাদের দেওয়া বিজ্ঞপ্তি দেখে অফিসে যেত। তখন তাদের মৌখিক সাক্ষাৎকারের ডাকে এবং চাকরি দেওয়ার নাম করে ৩ থেকে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত নিত। টাকা প্রদানকারী ব্যক্তিরা যখন ভুয়া প্রতিষ্ঠানের দেওয়া নিয়োগপত্র নিয়ে চাকরিতে যোগদান করতে যান; তখন তারা জানতে পারেন তাদের প্রদানকৃত নিয়োগপত্রটির কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানের কোনো ভিত্তি নেই। এ চক্র সারা দেশে ২ লক্ষাধিক চাকরিপ্রত্যাশীর কাছ থেকে আবেদনপত্র গ্রহণ করে প্রায় ২০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে।

র‌্যাবের এক কর্মকর্তা বলেন, বর্তমানে ব্রক মেডিকেল সেন্টার, মেরি স্টোপস, নামে-বেনামে মানবিক উন্নয়ন কেন্দ্র দিয়ে বিজ্ঞাপন প্রচার করা হয়। এসব বিজ্ঞাপন শতভাগ মিথ্যা। তাই সবার কাছে অনুরোধ— কোথাও চাকরির আবেদন করতে হলে ভালোভাবে বিজ্ঞাপন পড়ুন, জাতীয় কোনো পত্রিকায় সেটার বিজ্ঞাপন হয়েছে কিনা তা খুঁজে বের করুন। অভিজ্ঞদের সঙ্গে শেয়ার করুন। প্রতারিত হলে সঙ্গে সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানান।

সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন

Print Friendly, PDF & Email