|

ফুলবাড়িয়া আ’লীগের চ্যালেঞ্জ জাসদ, বিএনপিতে চাচা-ভাতিজার লড়াই

প্রকাশিতঃ ১১:৪৮ পূর্বাহ্ণ | নভেম্বর ০৮, ২০১৮

ডেস্ক রিপোর্ট, ভালুকার খবর: ময়মনসিংহ-৬ (ফুলবাড়িয়া) আসন নিয়ে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলীয় জোটের শরিক জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) মধ্যে রীতিমতো জট বেঁধেছে।

আওয়ামী লীগের স্থানীয় সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট মোসলেম উদ্দিন পাঁচবার এ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। এবার তাকে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছেন জাসদের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সম্পাদক ও মহানগর কমিটির সভাপতি সৈয়দ শফিকুল ইসলাম মিন্টু। দীর্ঘদিন গোটা উপজেলা চষে বেড়ানোর পাশাপাশি দুই বছরে দুইবার দলীয় প্রধান তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুকে নিয়ে বিশাল জনসভা করে নিজেদের সাংগঠনিক শক্তিমত্তা জানান দিয়েছেন তিনি।

ময়মনসিংহে অন্য কোনো আসন না পেলেও অন্তত এ আসনে মিন্টুর জন্য ‘নৌকা’ প্রতীক চান জাসদের নেতা-কর্মীরা। আসনটিতে মহাজোটের আরেক শরিক জাতীয় পার্টিতেও রয়েছে প্রার্থিতার লড়াই।

জাসদের মতো জাতীয় পার্টিও জোটগতভাবে আওয়ামী লীগের কাছে আসনটি দাবি করেছে। ভোটের মাঠে মহাজোটের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপিতে মনোনয়ন নিয়ে রয়েছে চাচা-ভাতিজার লড়াই।

চাচা বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য শামছ উদ্দিন আহমেদ ও ভাতিজা দক্ষিণ জেলা বিএনপির সদস্য আখতারুল আলম ফারুকের মধ্যে এ ইস্যুতেই সম্পর্কটা সাপে-নেউলে হয়ে গিয়েছে। নির্বাচন শিয়রে থাকলেও তাদের সম্পর্কের উন্নতি হয়নি মোটেও।

স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা জানান, প্রবীণ রাজনীতিক হিসেবে দলটির পাঁচবারের সাবেক সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট মোসলেম উদ্দিনের শক্ত অবস্থান রয়েছে দলে। দলীয় নেতা-কর্মী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ সবার সঙ্গেই নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে তার। ৫ টার্মে কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন উপহার দেওয়ায় একাদশ সংসদ নির্বাচনেও শেষ পর্যন্ত তিনিই নৌকার প্রার্থী হবেন।

ফুলবাড়িয়া উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি হারুন অর রশিদ বলেন, ফুলবাড়িয়া আওয়ামী লীগের দুর্ভেদ্য ঘাঁটি। এখানে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ঐক্যের প্রতীক হচ্ছেন অ্যাডভোকেট মোসলেম উদ্দিন। নির্বাচনের আগে অনেক প্রার্থীর দৌড়ঝাপ থাকলেও শেষ পর্যন্ত জননেত্রী শেখ হাসিনা তাকেই মনোনয়ন দেবেন।

স্থানীয় উপজেলা যুবলীগের সদস্য সাকের আহমেদ খান বলেন, ফুলবাড়িয়া আওয়ামী লীগ এবং মনোনয়ন রাজনীতিতে সাবেক গণপরিষদ সদস্য অ্যাডভোকেট মোসলেম উদ্দিন বিকল্পহীন। বার বার এমপি নির্বাচিত হয়ে তিনি এলাকায় রেকর্ড উন্নয়ন উপহার দিয়েছেন। আসনটি ধরে রাখতে বঙ্গবন্ধু কন্যা এবারো তার ওপরই আস্থা রাখবেন বলে হাজার হাজার নেতা-কর্মীর বিশ্বাস।

তবে দলীয় নেতা-কর্মীদের এমন প্রত্যাশার বিপরীতে সমালোচনাও রয়েছে দলীয় এই সংসদ সদস্যকে নিয়ে। ফুলবাড়িয়া ডিগ্রি কলেজ সরকারিকরণ না হওয়া এবং আন্দোলনে পুলিশের লাঠিপেটায় এক শিক্ষকের মৃত্যুর ঘটনায় ইমেজ সঙ্কটে পড়েছেন অ্যাডভোকেট মোসলেম উদ্দিন।

আবার মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলাও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। যদিও তার সমর্থকদের দাবি, আদালতে ওই মামলা অনেক আগেই খারিজ হয়েছে এবং সংসদ সদস্য ওই বাদীর বিরুদ্ধে পাল্টা মামলাও করেছেন।

এর বাইরে দলে অ্যাডভোকেট মোসলেম উদ্দিনের বিপরীতে রয়েছেন প্রায় হাফ ডজন প্রার্থী। তারা হলেন- উপজেলা আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট আবদুর রাজ্জাক, সাধারণ সম্পাদক আবদুল মালেক সরকার, জেলা আওয়ামী লীগের সহ-প্রচার সম্পাদক অ্যাডভোকেট মফিজ উদ্দিন মণ্ডল, উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক অ্যাডভোকেট আমিনুল ইসলাম খাইরুল।

এসব প্রার্থীরাও দীর্ঘদিন যাবত এলাকায় জনসংযোগ করে যাচ্ছেন। তাদের কারো সঙ্গে দলীয় সংসদ সদস্যের সম্পর্ক ভালো আবার কারো সঙ্গে রয়েছে যোজন যোজন দূরত্ব। মোসলেমকে ঠেকাতে কেউ কেউ আবার জাসদের সৈয়দ শফিকুল ইসলাম মিন্টুকে অপ্রকাশ্য সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন, এমন খবরও রয়েছে অন্দরে-বাইরে।

তবে নিজে মনোনয়ন পেলে জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগ নেতা মফিজ উদ্দিন মন্ডল। বাংলানিউজকে তিনি বলেন, দল আমাকে মনোনয়ন দিলে অবশ্যই বিজয়ী হবো।

আবার কোন কারণে সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট মোসলেম উদ্দিন প্রার্থী না হলে তার ছেলে উপজেলা আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা বিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট ইমদাদুল হক সেলিম প্রার্থী হতে পারেন। ৯০’র দশক থেকেই বাবার পাশে থেকেই রাজনীতি করছেন সেলিম।

নিজের প্রার্থিতার বিষয়ে  তিনি বলেন, ফুলবাড়িয়ার আপামর মানুষ নৌকা অন্তপ্রাণ। এখানকার ভোটাররা বঙ্গবন্ধু আর শেখ হাসিনা ছাড়া কিছুই বোঝেন না। বরাবরের মতো এবারো নৌকার পক্ষেই গণজোয়ার তৈরি হযেছে। আমরা আশাবাদী এবারো আসনটিতে রেকর্ড ভোটেই নৌকা বিজয়ী হবে।

তবে স্থানীয়রা জানায়, আসনটিতে এবার আওয়ামী লীগের জন্য চরম মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সম্পাদক সৈয়দ শফিকুল ইসলাম মিন্টু।

উপজেলার ভাঙাচুরা বেহাল রাস্তাঘাট, বিভিন্ন প্রকল্পে অনিয়ম-লুটপাট এবং সংসদ সদস্য ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম, দুর্নীতির অভিযোগ এনে আর কাঙ্ক্ষিত উন্নয়নের স্বপ্ন দেখিয়ে উপজেলার গ্রাম, ওয়ার্ড ও ইউনিয়নে ইউনিয়নে ভোটারদের কাছে বিরামহীন গতিতে ছুটছেন মিন্টু। যদিও অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ অস্বীকার করেছেন সংসদ সদস্যের সমর্থকরা।

গত দুই বছরে দুইবার তথ্যমন্ত্রী ও জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু ফুলবাড়িয়ায় বিশাল দুটি জনসভা করে মিন্টুকে ১৪ দলের প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করেছেন। তিনি এমনও বলেছেন, শেখ হাসিনা বটবৃক্ষ। তার নিচে আওয়ামী লীগের মোসলেম উদ্দিনকে নয়, সৎ, সাহসী ও কর্মঠ মিন্টুকেই মানায়। মিন্টুকে ভোট দিলে সে জনতার কাতারেই থাকবে। নিজের আখের গুছাবে না, লুটপাট করবে না।

নিজের মনোনয়নের বিষয়ে জাসদের ময়মনসিংহ মহানগর সভাপতি সৈয়দ শফিকুল ইসলাম মিন্টু বলেন, বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গোটা দেশে অভূতপূর্ব উন্নয়ন হয়েছে। তবে নেতৃত্বের ব্যর্থতার কারণেই ফুলবাড়িয়ায় কোন উন্নয়ন হয়নি। আমাকে জোটগতভাবে মনোনয়ন দেওয়া হলে আমি কাঙ্ক্ষিত উন্নয়নের পাশাপাশি আসনটি মহাজোটনেত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে উপহার দিতে পারবো।

এ আসন থেকে জাতীয় পার্টির ডা. কে. আর ইসলাম ও মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক কাস্টমস কর্মকর্তা মাহফিজুর রহমান বাবুল দলীয় মনোনয়ন চাইছেন। ’৯৬ সালের দিকে বিশিষ্ট চক্ষু চিকিৎসক কে. আর ইসলাম লাঙল প্রতীক নিয়ে ভোটের মাঠে নাড়া দিলেও এখন আর সেই অবস্থান নেই তার।

তাছাড়া নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী মাহফিজুর রহমান বাবুলকেও মোকাবেলা করতে গলদঘর্ম হতে হচ্ছে তাকে। দুই পক্ষের মাঝে দ্বন্দ্ব-সংঘাত ওপেন সিক্রেট। দলটির অনেক নেতা-কর্মীই কে. আর ইসলামকে ছেড়ে বাবুলের বলয়ে যোগ দিয়েছেন।

এদিকে, মনোনয়ন রাজনীতিতে বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য প্রকৌশলী শামছ উদ্দিন আহমেদকে শক্ত ঝাঁকুনি দিতে সক্ষম হয়েছেন সহোদর ভাতিজা দলটির জেলা কমিটির সদস্য আখতারুল আলম ফারুক। এক সময় স্থানীয় বিএনপিতে ছিলো দলীয় সাবেক সংসদ সদস্য শামছ উদ্দিনের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ।

কিন্তু মনোনয়ন নিশ্চিত এমন ধারণা তার রাজনীতির বারোটা বাজিয়েছে বলেই অনেকেই মনে করেন। এর সঙ্গে তার দাম্ভিকতা এবং ঢাকামুখী মানসিকতার কারণেই হারিয়েছেন নিজের অবস্থান।

এ সুযোগে দিনের পর দিন মাঠ রাজনীতিতে সক্রিয় এবং নেতা-কর্মীদের আপদে-বিপদে পাশে থেকে স্থানীয় দলীয় রাজনীতির লাগাম নিজের হাতে নিয়েছেন আখতারুল আলম। শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হকের নাত জামাই হওয়ার সুবাধে এবং বড় ব্যবসায়ী হওয়ার দৌলতে দলের হাইকমান্ডের সঙ্গেও তার ভালো বোঝাপড়া রয়েছে। ফলে ফারুকের ভাগ্যেই মনোনয়ন জুটবে এমন অভিমত তার অনুসারী-অনুগামীদের।

এর বাইরে বিএনপিতে প্রার্থী হিসেবে আলোচনায় রয়েছেন ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম সরকার। প্রার্থিতার বিষয়ে তিনি বলেন, দলের জন্য ত্যাগ রয়েছে। কারাবরণ করেছি, জুলুম নির্যাতনের শিকার হয়েছি। দল মূল্যায়ন করবে বলে আমি আশাবাদী।

আসনটিতে জামায়াতের জেলা কমিটির আমির অধ্যাপক জসিম উদ্দিনও প্রার্থী হতে পারেন। তবে নিবন্ধন বাতিল হওয়ায় তাকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবেও দেখা যেতে পারে।

সুত্র: বাংলানিউজ।

Print Friendly, PDF & Email