|

মানব সমাজে যাকাতের সামাজিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব

প্রকাশিতঃ ৫:৩৫ অপরাহ্ণ | মে ০৩, ২০২০

প্রভাষক আনোয়ার হোসেন তরফদার:

মানব সভ্যতার ইতিহাসে মানুষ যদি তার সবকর্ম সঠিক ভাবে পরিচালিত করতো তাহলে সমাজ জীবন হত অনেক সুন্দর। আমি বলছি যাকাতের কথা, আজকের সমাজ ব্যবস্হায় যদি যাকাতের সঠিক ব্যবহার থাকতো তাহলে দরিদ্র মানুষের লাইনে দাড়িয়ে ত্রাণ নিতে হতনা।

আমাদের সমাজের মাঝে যার উপর যাকাত ফরজ সে যদি তার দায়িত্ব সঠিক ভাবে পালন করে তাহলেই যাকাত দাতাও সম্মানিত হত যাকাত গ্রহিতাও সম্মানিত হত। যাকাত অর্থ হলো প্রশংসা করা, প্রাচুর্য লাভ করা, সংশোধন করা অর্থে শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে তবে প্রসিদ্ধ অর্থ হলো পবিত্র করন বা বৃদ্ধি করন। ধনী দরিদ্রের বৈষম্য দূর করে ও ভ্রাতৃত্ববোধের উন্মেষ তৈরি করে যাকাত ধনী দরিদ্রের মাঝে বৈষম্য দূর করে একটি ভারসাম্যপূর্ণ সমাজ সৃষ্টি করে। যাকাত দরিদ্রের প্রতি ধনীর করুণা নয়, বরং ধনীর সম্পদে দরিদ্রের অধিকার। মুসলিম জনগোষ্ঠী এক সুমহান ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে জড়িয়া থাকে যাকাতের কারণেই ভ্রাতৃত্ব যথাযথ রূপ ও সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে উঠে। এজন্য আল্লাহর তায়ালা বলেন, এরপর তারা যদি তওবা করে, সালাত কায়িম করে এবং যাকাত দেয় তাহলে দীনের সূত্রে তারা তোমাদের ভাই হবে। সূরা আত তাওবাহ ঃ১১ . সামাজিক নিরাপত্তা বিধান: সামাজিক নিরাপত্তা বিধানের ক্ষেত্রে যাকাতের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। সমাজের যে সকল লোক অর্থ উপার্জনে অক্ষম এবং সামাজিক নিরাপত্তাহীনতায় বাস করে, যাকাত ব্যবস্থা তা দূরীকরণে অনন্য ভূমিকা রাখে। অভাব-অনটন বিমোচন: অভাব-অনটন বিমোচনে যাকাত ব্যবস্থা অতীব গুরুত্বপূর্ণ।

সমাজের ধনী শ্রেণী যদি সঠিকভাবে যাকাত প্রদান করে তাহলে সমাজে কোনো অভাবী মানুষের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না। সামাজিক অনাচার নির্মূল: অর্থের অভাবে মানুষ সামাজিক অনাচার তথা চুরি, ডাকাতি, খুন, রাহাজানি, ছিনতাই ও সন্ত্রাস ইত্যাদি অপরাধে লিপ্ত হয়ে পড়ে। ভেঙে পড়ে সামাজিক অবকাঠামো। যাকাত ব্যবস্থা এসব সামাজিক অনাচার নির্মূলে অনন্য ভূমিকা পালন করে। সহানুভূতি সৃষ্টি: যাকাত ব্যবস্থার মাধ্যমে ধনীদের অন্তরে দরিদ্রদের প্রতি চরম সহানুভূতি সৃষ্টি হয়। ধনীরা দরিদ্রের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে এগিয়ে আসে। জনহিতকর কার্যাবলি: যাকাতের অর্থ সংগ্রহ করে সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগে সমাজের অসংখ্য জনহিতকর কার্যাবলি সম্পাদন করা যায়। ভিক্ষা বৃত্তি দূরীকরণ ভিক্ষাবৃত্তি একটি সামাজিক ব্যাধি। যাকাতের অর্থ দিয়ে দরিদ্র কল্যাণ ও দরিদ্রের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে ভিক্ষা বৃত্তি দূরীকরন করা যায়। সমৃদ্ধ সমাজ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে যাকাতের সামাজিক গুরুত্ব অনেক, মানুষ অভাবমুক্ত ও সচ্ছল হলে সমাজও অভাব মুক্ত এবং সচ্ছল হবে। দরিদ্রতার কষাঘাতে জীবন জর্জরিত না থাকলে মানুষের পক্ষে বিভিন্ন মানবিক গুণাবলীর বিকাশের সুযোগ হত। যাকাত অভাব হীন জীবন গড়ে দিয়ে সমৃদ্ধ সমাজ প্রতিষ্ঠা সম্ভব করে তোলে। যাকাতের অর্থনৈতিক গুরুত্ব অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে যাকাতের গুরুত্ব অপরিসীম।

ইসলামি অর্থনীতির মূল ভিত্তি: যাকাত ইসলামি অর্থনীতির মূল ভিত্তি। পুঁজিবাদী অর্থ ব্যবস্থার মূলভিত্তি। যেমন – সুদ, সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থার মূল ভিত্তি যেমন জাতীয়করণে তেমনি ইসলামি অর্থ ব্যবস্থার মূল ভিত্তি হলো যাকাত। রাষ্ট্রীয় আয়ের প্রধান উৎস: ইসলামি রাষ্ট্রের আয়ের প্রধান উৎস যাকাত। ইসলামি রাষ্ট্রের সিংহভাগ অর্থই যাকাত থেকে সংগৃহীত হয়ে থাকে। জাতীয় আয় বৃদ্ধি: যাকাত ইসলামি রাষ্ট্রের জাতীয় আয়কে বৃদ্ধি করে। রাষ্ট্রের অন্যান্য আয়ের সাথে যাকাতের অর্থ একত্রিত হয়ে জাতীয় আয় বহুলাংশে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। অর্থনৈতিক ভিত্তিকে সুদৃঢ় করে: কোনো রাষ্ট্রকে উন্নতি ও অগ্রগতির মূলে রয়েছে সুদৃঢ় অর্থনৈতিক ভিত্তি।

যাকাত ইসলামি রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ভিত্তিকে সুদৃঢ় করে। অর্থনৈতিক ভারসাম্য সৃষ্টি: রাষ্ট্রে ধনী-দরিদ্রের মাঝে যে বিশাল ব্যবধান রয়েছে। যাকাত ব্যবস্থা যথাযথ বাস্তবায়নের মাধ্যমে তা নিরসন করে ইসলাম একটি ভারসাম্যপূর্ণ অর্থ ব্যবস্থা গড়ে তোলে। অর্থনৈতিক বন্ধ্যাত্ব দূরীকরণ: যাকাত অর্থনৈতিক বন্ধ্যাত্ব দূরীকরণের মহৌষধ। কেননা যাকাত ব্যবস্থার কারণে বিত্তশালীদের অর্থ এক স্থানে সঞ্চিত থাকতে পারে না। সম্পদ সমাজের দরিদ্রদের মাঝে আবর্তিত হতে থাকে। দারিদ্র্য বিমোচন: দারিদ্র্য বিমোচনে যাকাতের ভূমিকা অনস্বীকার্য। সঠিকভাবে যাকাতের অর্থ দরিদ্রদের মাঝে বণ্টন করলে সমাজ থেকে দারিদ্র্য দূর হতে বাধ্য। ঋণমুক্তি: যাকাতের অর্থ দ্বারা ব্যক্তি সমাজ ও রাষ্ট্রকে ঋণমুক্ত করা যায়। চাকরির সুযোগ: রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় যাকাত উত্তোলন ও বিতরণের ব্যবস্থা করলে যাকাত বিভাগে অসংখ্য লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। পুঁজিবাদের অবসান: যাকাত ব্যবস্থা প্রবর্তনের ফলে পুঁজিবাদের অভিশাপ থেকে জাতি মুক্তি পাবে। ইসলামি অর্থ ব্যবস্থার এ মূলনীতিকে সামনে রেখেই আল্লাহর ঘোষণা: যাতে ধনৈশ্বর্য কেবল তোমাদের বিত্তশালীদের মধ্যেই পুঞ্জিভূত না হয়।

বেকার জীবন অভিশপ্ত জীবন। ইসলামের যাকাত ব্যবস্থা সমাজ থেকে বেকারত্ব দূরীকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যাকাতের অর্থ দিয়ে বেকার লোকদের কোনো না কোনো কাজের ব্যবস্থা করা যায়। যাকাত ব্যবস্থার মাধ্যমে মানুষের মাঝে প্রচলিত অর্থনৈতিক প্রতারণা বন্ধ করা যায়। আধুনিক কর ব্যবস্থায় ফাঁকির প্রবণতা থাকলেও যাকাত ব্যবস্থায় ফাঁকি অকল্পনীয়। কেননা বিত্তশালীরা একান্তই ধর্মীয় অনুভূতি নিয়ে আল্লাহর নির্দেশ পালনের লক্ষ্যে স্বেচ্ছায় যাকাত দিয়ে থাকে। কর্মসংস্থানের সৃষ্টি: যাকাতের অর্থ একত্রিত করে শিল্প-কারখানা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে অনেক কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যায়।

জনকল্যাণমূলক কাজ যাকাতের অর্থে এতিমখানা, বিদ্যালয় ও দাতব্য চিকিৎসালয় প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি জনকল্যাণমূলক কার্য- করা যায়। জাতীয় আয়, ইসলামি অর্থ ব্যবস্হায় রাষ্টীয় রাষ্ট্রীয় আয়ের প্রধান উৎস যাকাত। যার ওপর যাকাত ফরয হবে সে ব্যক্তি২.৫% হারে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে যাকাতের অর্থ জমা দেবে। এভাবে জাতীয় আয় বৃদ্ধি পাবে। পরে পরিকল্পিত ভাবে ব্যায়ের মাধ্যমে এ অর্থ অধিকতর লাভজনক অর্থে পরিনত করা সম্ভব হবে।

লেখক: প্রকাশক, ভালুকার খবর

Print Friendly, PDF & Email