|

ভালুকার স্বেচ্ছাসেবীদের বৃদ্ধাশ্রমে একদিন

প্রকাশিতঃ ১:২৮ পূর্বাহ্ণ | মে ১২, ২০১৮

রুমান আরিয়ান:

অনেক গুলো তারিখ পরিবর্তন হওয়ার পর আজ শুক্রবার আমাদের আবারো ছুটে চলা গাজীপুর (হোতাপাড়) বয়স্ক ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে।। উদ্দেশ্য গত বছরের ন্যায় এবছরেও একটি দিন বয়োজ্যেষ্ঠদের সাথে কাটানো, তাদের নিঃসঙ্গ জীবনে এক মূহুর্ত সময় সঙ্গ দেওয়া, নিরামিষ জীবনে একটু আনন্দ-বিনোদন দেওয়া, একটু গল্প – আড্ডা – নাচ- গান করা।।

গত বছরের ১০ মার্চ আমরা প্রথম গিয়েছিলাম এই বৃদ্ধাশ্রমে, কাটিয়েছিলাম একটি প্রাণবন্ত অসাধারণ দিন, পরিচিত হয়েছিলাম কয়েকজন বয়স্ক দাদু-দীদার সাথে, অর্জন কয়েছিলাম কিছু অসাধারণ অভিজ্ঞতা, আনন্দ করেছিলাম নাচে-গানে।।( তাদের নিমন্ত্রণ ছিলো আবার যাবার।।)

তারই ধারাবাহিকতায় আজকের ছুটে চলা।। গতকাল রাত থেকেই খুব এক্সাইটেড ছিলাম এবারের যাওয়া নিয়ে।। কেননা বৃদ্ধাশ্রমের কথা মনে পড়লেই গতবারের পরিচিত হওয়া কয়েকটি মুখ বেশে উঠে চোখের সামনে, ফিরে আসার সময়ের সেই কান্না মাখা চেহারা আজো আমাকে আবেগ প্রবণ করে।। ভাবতেছিলাম গতবারের সবাইকে পাবো তো?? কেউ মারা যায়নি তো??
আবার ভাবতেছিলাম গিয়ে যদি দেখতাম বৃদ্ধাশ্রম ফাঁকা, কেউ নেই, সবাইকে তাদের সন্তানেরা ফিরিয়ে নিয়ে গেছে বাসায়!! জীবনের শেষ সময় টুকু নাতী-নাতনীদের সাথে হেসে খেলে কাটাবে তারা!!

শুক্রবার সকাল,
ঘুম ভাঙ্গল একটু দেড়িতে, ফ্রেস হয়ে নাস্তা করে ভালুকা আসতে আসতে ঘড়িতে প্রায় ১২ টা।। এখনো অনেকেই এসে পৌছেনি, তাই জুম্মার নামাজটা ভালুকাতেই মসজিদে আদায় করে গাড়ী ছাড়তে বেলা ২.১০ টা।। শেরপুর থেকে ২ জন, মাওনা থেকে ১ জন, ময়মনসিংহ সদর, ত্রিশাল, ভালুকা থেকে ২২ জন ছেলে-মেয়েসহ মোট ২৫ জনের একটা টিম আমাদের।। রাস্তায় লাঞ্চ করে বৃদ্ধাশ্রমে প্রবেশ করার সময় ঘড়িতে বিকাল ৩.২০ টা।। আগে থেকেই অনুমতি নেওয়া থাকায় প্রবেশ করতে কোনো সমস্যা হয়নি।। (বলে রাখা ভালো বৃদ্ধাশ্রমে বহিরাগতদের প্রবেশ নিষেধ, আগের বারের মত সরাসরি দায়িত্বে থাকা ইনচার্জ এর রেফারেন্স নিয়ে আমাদের প্রবেশ ইমন ভাইয়ের মাধ্যমে)।।

প্রবেশ করার প্রথমেই গত বছর দেখে আসা দাদু দীদাদের খোজ নিলাম।। দু একজনকে রুমের বাহিরেই পেলাম, কুশলাদী জিজ্ঞেস করতেই ঝড়িয়ে ধরল, চিনতে পারেনি কোনো দাদু দীদাই (না চেনারই কথা, শুধু এক মূহুর্তের স্মৃতি)।। যাদের সাথে তাদের সারা জীবনের স্মৃতি ঝড়িত, নারীর – রক্তের -আত্মার সম্পর্ক তারাই তো তাদের ভুলে গেছে, দূরে সড়িয়ে রেখেছে।। তারা কেনো মনে রাখবে আমাকে এই সামান্য সময়ের পরিচয়ে ।। তবে তাদের স্মৃতি যে দূর্বল তা কিন্তু নয়, গত বছরের কথা তুলতেই চিনতে পারলো আমায়।। তাহলে তাদের শৈশব – কৈশর – যৌবনের কথা, তাদের আত্মীয়ের কথা, তাদের সাথের স্মৃতি, তা কি ভুলে গেছে?? জিজ্ঞেস করিনি, হয়তো স্পষ্ট চোখের সামনে ভেসে উঠে পেছনের সময় গুলো।।

না বৃদ্ধাশ্রম ছেড়ে বাসায় কেউ ফিরে যায়নি বা কাউকে নেওয়া হয়নি জানতে পারলাম।। বরং বয়স্কদের দল ভারী করতে আরো বেশ কয়েকজনকে একা করে রেখে গেছে এই বয়স্ক কারাগারে।। তবে এদের মধ্যে আবার দুই তিনজন তাদের রুম ত্যাগ করে দক্ষিণ পাশের কবস্থানে একটা স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছে,, (হয়তো অভিমান, তাই আর কখনো বাড়ীতে ফিরতে চায় না তারা, তাই) খুব নতুন একটা কবরও দেখলাম।।

যারা বেঁচে আছে তারা এখানে পরিবেশ গত দিক দিয়ে, পোশাক পরিচ্ছদের দিকে, খাবার -দাবার, চিকিৎসা -স্বাস্থ্য গত ভাবে খুব ভালোই আছে।। এখানে তাদের সব চেয়ে বড় অভাব হলো নিজের ছেলে- মেয়ে, নাতী – নাতনীদের সান্নিধ্য, ভালোবাসা, কথা বলার মত সঙ্গী, মানসিক প্রশান্তি, জীবনের তৃপ্ততা (যা বৃদ্ধ মানুষের অতীব প্রয়োজনীয়) ।।

সময় অল্প, সন্ধা হতে বাকি নেই বেশি, তাই খুব দ্রততার সাথেই শুরু হলো আমাদের মিনি কনসার্ট।। হিরক সিংগার, আল-মাহমুদ পিয়াস, আশরাফুল আলম ভাইয়ের অসাধারণ সব গানে কিছুক্ষণের মধ্যেই সবাই শুরু করলো নাচা-নাচি, তাদের নাচ দেখে আমরাও।। কেউ কেউ তো আবার গানও গাইলো।। আমি একটু বেশিই আবেগ প্রবণ তাই তাদের এ আনন্দ দেখেও আমার চোখে জল এলো, হয়তো তখন আমার নানু-দাদুর কথা খুব বেশিই মনে পড়ছিলো।। নানুকে হারিয়েছি প্রায় ১১ বছর হলো, আর দাদুকে প্রায় ৩ বছর।। আমার রূপকথার ঝুড়ি ছিলো এই দুজন, দুজনেরই প্রথম এবং সব চেয়ে আদরের নাতী ছিলাম আমি।।

কনসার্ট শেষ হলে আর তেমন সময় পাওয়া গেলো না তাদের সাথে কথা বলার, সন্ধা হয়ে এলো বলে।। মাগরিবের আযানের আগেই আমাদের বৃদ্ধাশ্রম থেকে বের হতে হবে।। তাই তাদের কাছ থেকে বিদায় নেবার পালা, কিন্তু বিদায় বেলাতেই তারা সব চেয়ে বেশি আবেগ প্রবণ হয়ে পড়ে আবার নিঃসঙ্গ হয়ে যাওয়ার ভয়ে, তাদের চোখ ভরে উঠে জলে।। বার বার বলতে থাকে “তোমরা আবার এসো, খুব শীগ্রই এসো, আমরা বেঁচে থাকতেই এসো কিন্তু!! তোমরা আসলে আমাদের খুব ভালো লাগে ” একটা অনিশ্চিত আশ্বাস দিয়ে বলি যে ‘খুব শীগ্রই আমরা আবার আসবো।’
বিদায় বেলা দোয়া চাইতে যাই তাদের কাছে, এক দাদু চোখ ভর্তি জল নিয়ে মাথায় হাত রাখে, ভেজা গলায় বলতে থাকে, “যত বড়/ব্যস্তই হও, যত গরিব/ধনীই হও না কেনো নিজের বাবা-মা, দাদু-দীদাকে কখনই দূরে সড়িয়ে দিও না, বৃদ্ধাশ্রমে তো নয়ই।।”
মনে হয় সেখানকার সবারই একই কথাই হবে।।

বিশেষ কৃতজ্ঞতা জানাই ইমন তালুকদার সাগর, আল-মাহমুদ পিয়াস ভাইয়ের প্রতি যাদের কল্যাণে পর পর দুই বছর এত সুন্দর একটা ইভেন্ট আমরা উপহার পেয়েছি, কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানাই এরকম ভিন্নধর্মী একটা ইভেন্ট আয়োজনের জন্য।। সামনে আরো চাই এই ইভেন্ট / এরকম ইভেন্ট।। অনেক মিস করেছি গতবার যারা সাথে গিয়েছিল কন্তু এবার যেতে পারেন নি তাদের।।

লেখক: শিক্ষক ও স্বেচ্ছাসেবী

Print Friendly, PDF & Email