|

শিক্ষার্থীর মেধা বিকাশে জরুরি…

প্রকাশিতঃ ১:২৭ পূর্বাহ্ণ | সেপ্টেম্বর ২৩, ২০১৮

আনোয়ারা নীনা:
যতই পড়িবে ততই শিখিবে-এর অর্থ কি এক বছরে এক ক্লাসে ১৪/১৫টি বই পড়া? এক বছরে অনেক বই পড়লে অনেক জ্ঞান অর্জন হবে এটা ভাবাটা মোটেও উচিত নয়। এক বছরে নামমাত্র, মূলতঃ ১০/১১ মাসে একটি ক্লাসে এতগুলো বই পড়ার কোন যুক্তি আছে বলে মনে হয় না।মাধ্যমিক পর্যায়ে ৬ষ্ঠ থেকে ৮ম শ্রেণির একজন শিক্ষার্থীকে ১৩/১৪টি পাঠ্য বই পড়তে হয়। বেশ কয়েক বছর যাবত শুরু হয়েছে। আমরা ছাত্রজীবনে এতো পড়িনি। তাই বলে কি সে সময় ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যারিস্টার, শিক্ষাবিদ ছিল না? তবে কেন এখন এতো পড়াশুনা? পড়াশুনা তো হচ্ছেই না বরং শুরু হয়েছে শিক্ষা ভীতি। প্রাথমিক পর্যায়ে একজন শিক্ষার্থী পড়ে আসছে মাত্র ৬টি বই। অথচ এই শিক্ষার্থী ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে এসে বছরের শুরুতে ১৩/১৪টি বই হাতে পেয়ে ভয় পাচ্ছে। যেখানে বছরের শুরুতে সরকারের সুন্দর অবদানস্বরূপ বিনামূল্যে বই দিচ্ছে, শিক্ষার্থী ও হাতে পাচ্ছে। তা পেয়ে শিক্ষার্থী আনন্দে উদ্বেলিত হওয়ার কথা। কিন্তু তা না হয়ে তাদের মধ্যে হচ্ছে ভীতির সঞ্চার। এমনিতেই শিক্ষার্থীর মাঝে রয়েছে বিষয়ভিত্তিক ভীতি যেমন ইংরেজি ভীতি, গণিত ভীতি। বিশ্বায়নের এই যুগে উচ্চ শিক্ষা থেকে শুরু করে চাকরি, ব্যবসা বাণিজ্য সকল ক্ষেত্রেই রয়েছে ইংরেজি দক্ষতার আবশ্যকতা। এই প্রেক্ষিতে ইংরেজি ভাষা রপ্ত করার বিষয়টিও জরুরি। কিন্তু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ইংরেজিতে নূ্যনতম দক্ষতা ও অর্জন করতে পারছে না। বরং শিক্ষার্থীর মাঝে সৃষ্টি হচ্ছে ইংরেজি ভীতি। শিক্ষাবিদরা বলছেন শিক্ষার্থীদের মধ্যে ইংরেজি ভীতির জন্য ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষা পদ্ধতিই দায়ী। আগের দিনে সাহিত্যে গুরুত্ব দেয়া হতো। কিন্তু কোন কোন শিক্ষাবিদের মতামতকে প্রাধান্য দেয়ার জন্য কমিউনিকেটিভকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। আমরা ইংরেজি শিক্ষা লাভ করেছি গল্প, কবিতা, ট্রান্সলেশান এগুলো পড়ে। কিন্তু তা এখন আর নেই বললেই চলে। তাই এ প্রসংগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমিরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, কমিউনিকেটিভ পদ্ধতি চালুর ফলে শিক্ষার্থীর কাছে ইংরেজি শিক্ষা দুর্বোধ্য হয়ে পড়েছে।

এডুকেশান ওয়াচ নামক সংস্থাটি যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায় পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের উপর ৫টি বিষয়ে ২৭টি দক্ষতা নির্দেশকের মাধ্যমে ৫৪ ধরনের প্রশ্ন করা হয়। এর মাঝে ইংরেজি বিষয়ে দক্ষতা নির্ণয়ে সবচেয়ে খারাপ ফলাফল এসেছে। প্রতিবেদনে দেখা যায় সবচেয়ে ভাল ফলাফল এসেছে বিজ্ঞান বিষয়ে। বিজ্ঞান বিষয়ে দক্ষতা অর্জনের হার ছিল ৮৩.৩ শতাংশ, বাংলাদেশ গ্লোবাল স্টাডিজে ৭৮.৭শতাংশ,বাংলায় ৭৩.৭ শতাংশ, গণিতে ৬৯.২ শতাংশ, ইংরেজিতে ৩৮ শতাংশ। তবে গ্রাম শহর ভেদে দক্ষতার হারের তফাৎ রয়েছে। ইংরেজি বিষয়ে শহরের শিক্ষার্থীরা গ্রামের শিক্ষার্থীর তুলনায় এগিয়ে। বিশেষ করে মফস্বল বা গ্রামে একটি শিশু জন্মের পর যতদিন না সে স্কুলে যায় ততদিন ইংরেজি শব্দ আদৌ শুনতে পায় কি না ভেবে দেখতে হবে। বিশেষ করে বাবা মা যদি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত না হয় তবে তো কথাই নেই। কিন্তু যাদের বাবা মা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত তাদের একটি সন্তান জন্মের পর যখন আধো আধো কথা বলতে শিখে তখনি বাবা মা তাদের শিখায় এটা ওয়াটার, এটা কেট, এটা ডগ, এটা ম্যাংগো, ফিংগার, আই, লিপ, হেয়ার, নোজ, টিথ, ল্যাগ, হ্যান্ড ইত্যাদি আরো অনেক কিছু। আর সেই বাচ্চাটি যার বাবা মা শিক্ষিত নয় তাকে এই ওয়ার্ডগুলো প্রতিষ্ঠানে গিয়ে শিখতে হয়। তখন তার অবস্থা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।এগুলো শিখতে না শিখতেই আবার কমিউনিকেটিভ পদ্ধতি। ঐ বাচ্চার মাথা তো কম্পিউটার না। সুতরাং সে কতটুকু লোড নিতে পারবে সেটা বুঝতে হবে। শিক্ষকগণ বুঝলেও কোন লাভ নেই কারণ আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় যা আছে তা তো শিক্ষককে ফলো করতে হবে। শিক্ষক তো শিক্ষা গবেষকও না শিক্ষাবিদও না। সুতরাং যা আছে তাই ফলো করতে হবে। তারপর যখন সেই বাচ্চাটি ইংরেজি ভালো করতে পারবে না তখন ফল প্রকাশ হবে শিক্ষক দক্ষ না। ভাল পড়াতে পারেনি। যত দোষ নন্দ ঘোষ। আমাদের উদ্দেশ্য যদি ইংরেজিতে দক্ষ করতে হয় তবে কমিউনিকেটিভ বাদ দিয়ে সেই আগের পদ্ধতিতে ফিরে যাওয়াই উত্তম বলে মনে করি। কমিউনিকেটিভ ভাল শিক্ষার্থীর জন্য ভাল। কিন্তু দুর্বল শিক্ষার্থী সবল হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই নাই।

গণিত ভীতি শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বের প্রায় সব দেশেই শিক্ষার্থীদের মাঝে রয়েছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশে এই গণিত ভীতি দূর করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। প্রাইমারি স্কুল থেকেই এই গণিত ভীতি শুরু হয়। তাই পরবর্তীতে এই ভীতি আরও প্রকট আকার ধারণ করে। তাই প্রাথমিকের গন্ডিতেই এই ভীতি দূর করতে হবে। গণিত মামুষের বাস্তব জীবনে কিভাবে কাজে লাগে তা প্রতিটি শিক্ষার্থীর ধারণায় আনতে হবে। আজকাল ছোটদের গণিত শিখার জন্য মোবাইল বা নেটে অনেক ধরনের আ্যাপস রয়েছে। যা দিয়ে গণিতকে খুব সহজেই খেলার ছলে সহজবোধ্য করা যায়।

এ ক্ষেত্রে দায়িত্বটা শুধু মাত্র একজন শিক্ষকের নয়। শিক্ষার্থীর অভিভাবকেরও রয়েছে। বিশেষ করে বাচ্চাদের জন্য ঊফঁপধঃরড়হধষ গধঃয এধসব খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। খরঃঃষব চধহফধ এবহরঁং আ্যাপটি চমৎকার আ্যনিমেশান সন্তানদের অংক শেখার জন্য দারুণভাবে আকৃষ্ট করে। পাটি গণিতে দক্ষ করতে গধঃয ঘরহলধ ঞরসব ঞধনষব এই আ্যপটি ব্যবহার করা যেতে পারে। গণিত ভীতি দূর করতে চাইলে শিশুকে চাপিয়ে দিয়ে নয় মজা করে গণিত শিখাতে হবে। সে ক্ষেত্রে আমাদের পাঠ্যবইয়ের পরিমার্জন আবশ্যক। যুক্তরাষ্টের ভার্জিনিয়া পলিটেকনিক ইন্সস্টিটিউট এন্ড স্টেট ইউনিভার্সিটির গবেষক ঝে ওয়াং বলেন, আমাদের গবেষণায় বলছে গণিত নিয়ে ভীতি- গণিত শিখা এই পরস্পর বিরোধী সম্পর্ক সর্বজনীন নয়। তবে এমনটি সত্যি ঘটবে। অবশেষে বলতে হচ্ছে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষার মান উন্নয়নের লক্ষ্যে আমাদের মাধ্যমিক পর্যায়ে পাঠ্য বইয়ের সংখ্যা কমাতে হবে। বইয়ের মান উন্নয়ন করতে হবে, আরো সহজবোধ্য করতে হবে। বিষয় ভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে, শিক্ষক নিয়োগ ত্বরান্বিত করতে হবে, প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা আরো জোরদার করতে হবে।

লেখক- প্রধান শিক্ষক,
হালিমুন্নেছা চৌধুরাণী মেমোরিয়াল বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়।
Print Friendly, PDF & Email