ভালুকার কাঁচি কবিরাজের তেলেসমাতি
প্রকাশিতঃ ১০:৪৯ পূর্বাহ্ণ | অক্টোবর ২৫, ২০১৮
মির্জা মেহেদী তমাল: কয়েকশ’ নারী পুরুষ সারিবদ্ধভাবে লাইনে দাঁড়ানো। সবার হাতে ছোট ছোট বোতল। কারও বোতলে তেল, কারও বোতলে পানি। প্রত্যেকেই বোতল হাতে নিয়ে আকাশের দিকে তুলে ধরে আছেন। এক ব্যক্তির হাতে লোহার তৈরি কাঁচি। তিনি এক জায়গায় দাঁড়িয়ে অদ্ভুত ভঙ্গিতে কাঁচি ঘুরাচ্ছেন আর ফুঁ দিচ্ছেন। লোকটির ঝাড়ফুঁক শেষ হলে পরম ভক্তিতে তেল পানি ভর্তি বোতল নিয়ে সহজ সরল অসুস্থ মানুষগুলো নিজ নিজ গন্তব্যের দিকে ফিরে যাচ্ছেন। আবারও নতুন লাইন। আবারও কাঁচি নিয়ে ঝাড়ফুঁক। চলছে এভাবেই দিনের পর দিন।
কাঁচি হাতের এই ব্যক্তিটি ‘কাঁচি কবিরাজ’ নামে পরিচিত। কেউ কেউ ‘কাঁচি বাবাও’ বলে থাকেন। ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলার মল্লিকবাড়ি ইউনিয়নের বর্তা গ্রামে এই কাঁচি বাবার আবির্ভাব ঘটেছে। গ্রামের রহিম মিয়ার ছেলে উজ্জ্বল মিয়া ছিলেন একজন রাজমিস্ত্রী। এখন তিনি ‘কাঁচি কবিরাজ’। কাঁচি কবিরাজের তেলেসমাতি কাণ্ডে ওই গ্রামে রীতিমতো মজমা বসে গেছে।
কাঁচি কবিরাজের ঝাড়ফুঁক দেওয়া তেল ও পানিতেই সেরে যাবে যে কোনো রোগ, পূরণ হবে মনোবাসনা, সমাধান মিলবে হাজারো মুশকিল। এমন গায়েবি খবরে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রতিদিন দলে দলে মানুষ ছুটে আসছে সেই গ্রামে। আসছেন মানসিক রোগী, প্রতিবন্ধী, বাতব্যথা, সাপে কাটাসহ সব ধরনের রোগী। রোগ মুক্তি ঘটেছে- এমন কোনো তথ্য প্রমাণ কেউ না পেলেও এসব রোগীর বিশ্বাস, কাঁচি কবিরাজের কাঁচির ছোয়ায় রোগমুক্তি ঘটবে তাদের। ঘটনাটি ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলার মল্লিকবাড়ি ইউনিয়নের বর্তা গ্রামের। গ্রামের রহিম মিয়ার ছেলে উজ্জ্বল মিয়া ছিলেন একজন রাজমিস্ত্রী। এখন তিনি কাঁচি কবিরাজ। কেউ কেউ বলেন আবার কাঁচি বাবা। তিনি একসঙ্গে ৫০০ থেকে এক হাজার নারী পুরুষকে লাইনে দাঁড় করিয়ে তেল ও পানির বোতল আকাশের দিকে তাঁক করিয়ে রাখার নির্দেশ দিয়ে লোহার তৈরি কাঁচি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ঝাড়ফুঁক দেন।
জানা যায়, প্রায় দুই মাস আগে উজ্জ্বল মিয়ার মা হেনা আক্তারকে বাড়ির পাশে লাকড়ি কুড়াতে গেলে সাপে কাটে। পরে বাড়িতে এসে তার ছেলে উজ্জ্বলের কাছে সাপে কাটার কথা বললে সাপের বিষ অলৌকিক ক্ষমতার মাধ্যমে উজ্জ্বল তার নিজের শরীরে নিয়ে নেয়। তার পর বিষয়টা জানাজানি হলে প্রথমে সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসা দেওয়া শুরু করে উজ্জ্বল। পরে বাত ও ব্যথার জন্য পানি ও সরিষার তেল পড়া দিয়ে স্থানীয় ফারম্নখ মিয়ার স্ত্রী জাহেরা খাতুন ও ওই এলাকার এনামুলের বাতের ব্যথার চিকিৎসা দেয়। এরপর ছড়িয়ে পড়ে বিদ্যুৎ গতিতে। যে গতিতে খবর ছড়ায়, একই গতিতে মানুষের ঢল নামে ওই গ্রামে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত্ম থেকে কাঁচি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ঝাড়ফুঁক দেওয়া তেল ও পানি পড়া নিতে আসে মানুষ। এ তেল ও পানি পড়ার বিনিময়ে কোনো প্রকার টাকা বা উপহার নেননা বর্তমানে ‘কাঁচি কবিরাজ’ হিসেব পরিচিত উজ্জ্বল। প্রতিদিন তেল ও পানিতে ঝাড়ফুঁক দিয়ে পড়ে নিতে বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রায় ২ থেকে ৩ হাজার মানুষ আসে এখানে।
আমাদের ময়মনসিংহ ভালুকা প্রতিনিধি মো. আসাদুজ্জামান সুমন কাঁচি কবিরাজের গ্রাম সরেজমিন নানা তথ্য পেয়েছেন। অনুসন্ধানে ও কাঁচি কবিরাজের খাদেমদের কাছ থেকে চোখে পড়ার মতো কোনো রোগী সুস্থ হয়েছে বা কারও মনোবাসনা পূরণ হয়েছে এমন তথ্য মিলেনি। যারা কোনো প্রকার উপকারিতা না পায় তাদেরকে বলা হয় একদিনে এটা হবে না নিয়ম করে অন্তত ৩ দিন আসতে হবে। প্রতিবেদক পরিচয় গোপন রেখে স্বপ্নে সাপে কেটেছে অভিনয় করে কবিরাজের চিকিৎসা নিতে যায়। পরে কবিরাজ কাঁচি দিয়ে প্রকৃত সাপে কাটা রোগীর মতই তুলা রাশি ব্যাক্তির মাধ্যমে শরীর থেকে বিষ নামায়। প্রতিবেদককে বিষমুক্ত করার পর বাড়িতে চলে যেতে বলা হয়। পরে প্রতিবেদক স্বপ্নে সাপে কাটার বিষয়টি অভিনয় জানালে কবিরাজ ক্ষিপ্ত হয়ে বলে তোর শরীরে অন্য বিষাক্ত বিষ ছিল।
নেত্রকোনা থেকে আসা সুফিয়া বেগম (৭০) কোমরে বাত ব্যথার জন্য এখানে আসেন। এটা তার চিকিৎসার ২য় দিন। দিন-তারিখ-সময়-মুহূর্তসই নিয়মমাফিক মোট ৩দিন আসতে হবে এখানে। বৃদ্ধা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলেন, “বাবারে যে নিয়ম দিছে কবিরাজ ওইডা আমি মাইনা (মেনে) চলবার পারতামও না, আমার কম্মর (কোমর) বেদনাও (ব্যথা) বালা অইতো না”।
কিশোরগঞ্জ থেকে প্রতিবন্ধী ছেলে রাছেল (১৫) নিয়ে আসা বাদল ফকির বলেন, “আমার পাশের গ্রামের এক বুবা মেয়ে নাকি এখানে এসে ভালো হয়েছে তাই আমার ছেলেকে নিয়ে আসলাম দেখি আল্লাহ্ কি করে। ওই বিশ্বাস থেকেই এখানে আসা। অনুসন্ধানে দেখা যায়, উপজেলার বাসট্যান্ড থেকে ওই এলাকার অটো-রিকশা চালকসহ স্থানীয় কয়েক জনের একটি চক্র আগত নারী-পুরুষদের আগ্রহের সঙ্গে জানাচ্ছেন রোগ মুক্তি ও মুশকিল আসানের গল্প। দাবি করছেন নিজের চোখে দেখারও। আসাদ নামের এক যুবক বলেন, তার পরিচিত বেশ কয়েকজন বাতব্যথা, অন্ধ, বোবা, শ্বাসকষ্টের রোগীরা এখানে এসে সুস্থ হয়েছে। কাঁচি কবিরাজের তেলেসমাতিতে ওই গ্রাম সবসময় উৎসবমুখর। সেখানে বাজার বসেছে। নতুন নতুন দোকানপাট রেস্টুরেন্ট গড়ে উঠেছে। প্রতিদিন বিক্রি হচ্ছে কয়েকহাজার বোতল। রোগীদের কাছ থেকে এখনো কোনো টাকা পয়সা প্রকাশ্যে না নিলেও তাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা দোকানপাট বাজার থেকে তিনি তার ভাগেরটা নিচ্ছেন। কাঁচি কবিরাজ নিজের পেশা ছেড়ে ঝাড়ফুঁকে নেমেছেন। তাদের অবস্থাও আদের চেয়ে ভালো হলেও রোগীদের কোনো উন্নতি হচ্ছে না। স্থানীয় অনেকেই কাঁচি কবিরাজের ঝাড়ফুঁককে প্রতারণার সঙ্গে তুলনা করছেন। এ ব্যাপারে স্থানীয় চেয়ারম্যান আলহাজ এস এম আকরাম হোসেন জানান, আমি বিষয়টি খোঁজ নিতে সশরীরে দেখতে গিয়েছি। কেউ কেউ বিভিন্ন রোগ-বালাই থেকে ভালো হচ্ছে বলে দাবি করছে তারা। উপজেলা নির্বাহী অফিসার মাসুদ কামাল জানান, বিষয়টি আমি শুনেছি, এ বিষয়টা খতিয়ে দেখার দরকার আছে। আমরা অনুসন্ধান করছি। অতি শীগ্রই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সুত্র: বাংলাদেশপ্রতিদিন।


