|

‘পোলাডারে আইন্না দেও, ওরে লইয়া বাড়িত যামু’

প্রকাশিতঃ ২:০৮ পূর্বাহ্ণ | মে ১২, ২০১৮

এম আবদুল্লাহ আল মামুন খান:  গ্রামে রাজমিস্ত্রির চাহিদা কম। তাই ছেলে আর সহযোগীদের সঙ্গে নিয়ে একটি ভবনের নির্মাণ কাজ করতে দিন কয়েক আগে ময়মনসিংহ শহরে গিয়েছিলেন আইয়ুব আলী (৫৫)। কাজ শেষে সপ্তাহের ছুটির দিনে দুপুরে বাড়ি ফেরার খুশির খবর প্রথমেই স্ত্রী করফুলিকে (৪৫) দেন তিনি।

‘আমগোর কাম (কাজ) শেষ। আইয়া পড়তাছি। রান্দা-বান্দা (রান্না-বান্না) কইরা লও। সবাই মিইল্যা (মিলে) একসাথে খাইমু (খাবো)।’ স্ত্রী করফুলির সঙ্গে আইয়ুবের শেষ কথা ছিল এমনই।

খুশির এ খবর করফুলির মনে স্থায়ী হয়নি বেশিক্ষণ। ঘণ্টা দু’য়েক পরেই বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতোই পেয়েছেন ভয়ানক দুঃসংবাদ। বাড়ি থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরেই তার স্বামী ও সন্তানের জীবনের পথ শেষ হয়েছে। ছেলে আব্দুল করিমকে (২৫) সঙ্গে নিয়েই চিরতরে ঘুম দিয়েছেন স্বামী আইয়ুব আলী।

শুক্রবার (১১ মে) বিকেল সোয়া ৩টার দিকে ময়মনসিংহ-হালুয়াঘাট সড়কের তারাকান্দা উপজেলার কাকনী এলাকায় হালুয়াঘাট থেকে ছেড়ে আসা ইমাম পরিবহনের একটি বাস কেড়ে নিয়েছে বাবা-ছেলেসহ ছয়টি তরতাজা প্রাণ।

বিপরীত দিক থেকে আসা ফুলপুরগামী একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশার যাত্রী ছিলেন তারা। কিন্তু দু’টি যানের মুখোমুখি সংঘর্ষে থেমে গেছে জীবনের আলোকাধা।

নিহতদের পারিবারিক সূত্র জানায়, হালুয়াঘাট উপজেলার নাগলা গড়পাড়া এলাকার আইয়ুব আলীর সঙ্গেই নগরীতে কাজ করতে গিয়েছিলেন ছেলে আব্দুল করিম (২৪), সলিম উদ্দিন (২২), মাজাহারুল (১৮) ও সিলেটের নাজিম উদ্দিন (২৮)।

কাজ শেষে ময়মনসিংহ থেকে বাড়ির উদ্দেশে যেতে তারা শহরের পাটগুদাম ব্রিজ মোড় থেকে নিজ এলাকার নূরে আলম ওরফে সোনা মিয়ার অটোরিকশায় চেপে বসেন।

দুর্ঘটনার পরপরই নিহতদের মরদেহ তারাকান্দা থানা কার্যালয়ের সামনে এনে রাখা হয়। বাবা-ছেলের মৃত্যুতে যেন নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে গোটা পরিবার। চারপাশে  নেমে আসে শোকের ছায়া।

বোনের স্বামী আর ভাগ্নে আব্দুল করিমের মরদেহের পাশে বিলাপ করছিলেন করফুলির ছোট ভাই রেজাউল করিম (৪০)।  তিনি বলেন, ‘আমরা গিরস্থের (গৃহস্থ) কাম (কাজ) করতাছিলাম। হেই (ওই) সময় থানাত্তে (থানা থেকে) ফোন দিয়া কয় আফনাদের (আপনাদের) লোক মইরা (মৃত) গেছে। আইসা দেহি বইন জামাই (বোন জামাই) ও ভাইগনার (ভাগ্নে) লাশ। আমার বইন (বোন) কেমনে (কীভাবে) চলবো। সংসার চালাইবো (চালাবে) কারা (কে)?’

নিহত আব্দুল করিমের নানি নুরুন্নাহার (৬০) সহ অন্য স্বজনরাও আহাজারি করছিলেন। তাদের আর্তনাদে ভারী হয়ে ওঠে থানার ভেতরের বাতাস। ‘অগর (ওদের) বউ-পোলাপানরে (স্ত্রী-সন্তান) কী কইয়া (বলে) বুঝাইমু (সান্ত্বনা)? ওরা কী লইয়া (নিয়ে) বাজবো (বাঁচবে),’ বলছিলেন পথচারী লোকজনও।

থানার মসজিদের পাশেই মাটিতে বসে বারবার মুর্ছা যাচ্ছিলেন সিদ্দিকুর রহমান (৫০)। সড়ক দুর্ঘটনায় তিনি হারিয়েছেন নাড়ি ছেঁড়া ধন মাজাহারুলকে। রক্তের বাঁধনের মৃত্যু সংবাদ শুনে ছুটে এসেছেন থানায়। বারবার বলছেন, ‘আমার পোলাডারে আইন্না (এনে) দেও। আমি ওরে লইয়া (নিয়ে) বাড়িত যামু (যাবো)।’

সরেজমিনে এ দুর্ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, ঘাতক বাস ও ধুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া সিএনজিচালিত অটোরিকশাকে ঘিরে ভিড় করছেন শোকাহত মানুষ। চিড়ে-চ্যাপ্টা অটোরিকশা দেখেও ভয়ে আঁতকে উঠছেন সবাই!

স্থানীয়রা জানান, বাস ও অটোরিকশার চালকের ভুলের কারণেই মারাত্মক এ দুর্ঘটনা ঘটেছে। এজন্য দু’টি যানের বেপরোয়াভাবে ছুটে চলাকেই দায়ী করেন তারা।

তবে এ প্রাণহানির ঘটনায় আইয়ুব আলী ও আব্দুল করিমের স্বজনরা দাবি করেন, ইমাম পরিবহনের চালকের ভুলের কারণেই এ দুর্ঘটনা ঘটেছে।

এ বিষয়ে তারাকান্দা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাজাহারুল হক বলেন, এ দুর্ঘটনার জন্য বাস ও অটোরিকশা চালক উভয়েই দায়ী। দুই চালকের বেপরোয়া মনোভাবের কারণেই ছয়টি তাজা প্রাণ ঝরে গেছে। আমরা বাস ও অটোরিকশা উদ্ধার করে থানায় নিয়ে এসেছি। নিহতদের স্বজনদের হাতে মরদেহ হস্তান্তর করা হয়েছে।

এদিকে সৎকারের জন্য জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রত্যেক নিহতের পরিবারকে ২০ হাজার টাকা করে দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক (ডিসি) ড. সুভাষ চন্দ্র বিশ্বাস। তিনি জানান, নিহতদের নাম-ঠিকানা সংগ্রহ করে তাদের স্বজনদের হাতে এ টাকা তুলে দেওয়া হবে।

Print Friendly, PDF & Email