রাজনীতির সদরে এক অন্দরে আরেক -নঈম নিজাম
প্রকাশিতঃ ৫:৩৩ পূর্বাহ্ণ | জুন ১০, ২০১৮

দেশে চলছে হুমড়ি খেয়ে চলার যুগ। নীতি, নৈতিকতা বিসর্জন ও সামাজিক অবক্ষয়ের যুগ। এখন শুনি ছাত্রলীগ নেতাদের এক অংশ নাকি এসেছেন ছাত্রদল, ছাত্রশিবির থেকে। আরেক অংশ ব্যস্ত ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে। কেউ কেউ ব্যস্ত সাকুরা বার নিয়ে। এ নিয়ে কমিটি করতে বিলম্ব হচ্ছে। শুনতেই যেন কেমন লাগে। একটা যুগে এমন চিন্তাও করা যেত না। এখন সব কিছু স্বাভাবিক। রাজনীতি ও ক্ষমতার অন্দর মহলে অনেক কিছু হয়। যা বাস্তবের সঙ্গে মেলানো যায় না। অবশ্য অতীতেও অনেক কিছু হতো রাজনীতির নামে, ক্ষমতার নামে, যার কোনো ব্যাখ্যা তখনো ছিল না। এখনো নেই। যুগের সঙ্গে, সময়ের সঙ্গে অনেক কিছুর পরিবর্তন হয়। আমাদের তা মেনে নিতে হয়। মুঘল সাম্রাজ্যে পুত্র শাহজাদা সেলিমের প্রেম নিয়ে একবার সম্রাট আকবরের উৎকণ্ঠার শেষ ছিল না। আনারকলি নামের এক অপরূপা সুন্দরীর নাচ-গানে মুগ্ধ হয়ে শাহজাদা সেলিম তার প্রেমে পড়েন। শুধু প্রেম নয়, তাকে বিয়েরও সিদ্ধান্ত নেন। সম্রাট আকবর পুত্রের এই কাণ্ড মেনে নিতে নারাজ। লড়াই শুরু হয় পিতা-পুত্রের। এই লড়াই অন্দর মহল থেকে ছড়িয়ে পড়ে যুদ্ধের ময়দানে। শাহজাদা সেলিম বিদ্রোহী হন। তাকে দমন করতে যুদ্ধের ঘোষণা দেন ক্ষমতাধর সম্রাট আকবর। একপর্যায়ে শাহজাদা সেলিমকে রাজদ্রোহী হিসেবে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। অন্দর মহলে এই খবর ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু রানী যোধা বাঈ কিছুতেই পুত্রের প্রতি এই নির্দয় অবস্থান মানতে নারাজ। এ নিয়ে আকবরের সঙ্গে রানীরও দূরত্ব তৈরি হয়। সম্রাটকে স্বাভাবিক করতে রানী একদিন তার অবস্থান ব্যাখ্যা করেন। তার দুই চোখজুড়ে অশ্রু। যোধা বাঈকে বলা হতো, সবচেয়ে দাপুটে। কিন্তু সন্তানের মায়া বলে কথা। আবেগাপ্লুত রানী অশ্রু চোখে সম্রাটকে প্রস্তাব দেন শাহজাদা সেলিমের মৃত্যুদণ্ড রহিত করার। জবাবে দিল্লির সম্রাট বললেন, তুমি স্রেফ মা, এর বাইরে ভারতবর্ষের রানী হতে পারনি। ন্যায়, অন্যায়ে আমার কাছে পুত্র বলে কিছু নেই। সবাই সমান। জবাবে যোধা বাঈ বললেন, আপনি শুধুই ভারতবর্ষের সম্রাট। আর কিছু নন। মন বলে কিছুই আপনার নেই। আকবর রানীর দিকে তাকালেন। তারপর বেরিয়ে গেলেন। দিল্লির পুরো রাজদরবার আকবরকে অনুরোধ করল দয়া করুন। আকবর তার সিদ্ধান্তে অনড়। তিনি তার অবস্থান থেকে নড়লেন না।
রাজনীতির হিসাব বড়ই জটিল, সব সময় সবকালে। তার মাঝেও এগিয়ে চলা। এখানে যুদ্ধ থাকবে, সংঘাত থাকবে, সংঘর্ষ থাকবে কিন্তু বন্ধ হবে না পথ চলা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর জাপান নিজেদের শক্তিশালী দেশে রূপান্তরের সিদ্ধান্ত নেয়। তখন জাপান সরকার বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পড়াশোনারত তাদের সব ছাত্রছাত্রীকে দেশে ফেরার নির্দেশ দেয়। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে অনেকের আসার কোনো আগ্রহ ছিল না। কিন্তু সরকার তার সিদ্ধান্ত বদলাবে না। কারণ যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে নতুন করে গড়ে তুলতে হবে। আর গড়ে তুলতেই দরকার বিদেশে পড়াশোনা করা ছাত্রদের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানো। জাপানকে বদলে দিতে এই ছাত্রদের বিভিন্ন খাতে কাজে লাগায় জাপান সরকার। তাদের চিন্তা, অভিজ্ঞতা ও পড়াশোনা জাপানকে সমৃদ্ধ করতে ভূমিকা রাখে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপান চীনের বিশাল অংশ তাইওয়ান, ভিয়েতনাম, লাউস, কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশ দখল নিয়ে নেয়। জাপানি সৈনিকরা আমাদের চট্টগ্রাম, ফেনী পর্যন্ত চলে এসেছিল। শুধু তাই নয়, যুদ্ধে পরাজয়ের পরও অনেকে ভেবেছিলেন, জাপান শেষ হয়ে যাবে। না জাপান শেষ হয়নি। বরং দেশটি বিশ্ব অর্থনীতির বড় জায়গা দখল করে আছে। জাপানিরা প্রচণ্ড পরিশ্রমী। তারা কাজটাকে গুরুত্ব দেয়। আমরা এগিয়ে চলছি। আমাদের দক্ষ মানবসম্পদ অনেক বেশি দরকার। বিদেশে অবস্থানরত আমাদের ছাত্রছাত্রীদের দেশে আসার বিষয়ে উৎসাহিত করতে হবে। তাদের কাজে লাগাতে হবে। অন্যথায় তারা বিদেশে থেকে যাবে। তাদের মেধা মনন কাজে লাগবে অন্য দেশের। পাশাপাশি দেশের প্রতিটি স্তরে দক্ষ কারিগরি শিক্ষাকে গুরুত্ব দিতে হবে। দেশে দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তুলতে হবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাঠানো শ্রমিকদের দক্ষ ও কারিগরি শিক্ষা দিয়ে পাঠাতে পারলে তারা অনেক ভালো করবে। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশি শ্রমিকরা এখন সবুজ সৃষ্টি করছে। বাংলাদেশের সবজি বাগান আর মাছ চাষ করছে তারা মরুভূমিতে। আবার বাংলাদেশেও বিভিন্ন খাতের অনেক পরিবর্তন আমাকে মুগ্ধ করে দেয়। বিদেশি অনেক ফল, ফুল আমাদের দেশে উৎপাদন হয়। ড্রাগন ফল, স্ট্রবেরি, আরবের খেজুর, থাইল্যান্ডের রামবুটাম এখন বাংলাদেশে উৎপাদন হচ্ছে। একটা সময় ছিল কেউ ভাবতে পারত না ঠাকুরগাঁও পঞ্চগড়ে চা উৎপাদন হবে। কৃষি খাতে বিশাল পরিবর্তন। গ্রামগঞ্জের অনেক কিছু বদলে যাচ্ছে। আমাদের খাবারে ডাইভারসিটি এসেছে। মাঝরাতে সাহরি খেতে মানুষ রেস্টুরেন্টে যাচ্ছে। ইফতারে কোনো রেস্টুরেন্টের আসন খালি থাকে না। মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বেড়েছে। মানুষ চাকচিক্যের দিকে ঝুঁকেছে। এই পরিবর্তনের পাশাপাশি মানুষের নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধ হ্রাস পাচ্ছে। হিংসা-বিদ্বেষ বেড়ে চলছে। সামাজিক গণমাধ্যমের দিকে তাকালে তার চিত্র দেখতে পাই।
জীবন খুব ক্ষণস্থায়ী। এই জীবন নিয়ে এত লড়াইয়ের কিছু নেই। কাজ করে যেতে হবে। চাওয়া-পাওয়ার হিসাবগুলো সব সময় মিলবে না। কিন্তু এগিয়ে চলাকে থামানো যাবে না। জটিলতাকে পার করে সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করতে হবে। জাগিয়ে তুলতে হবে নতুন এক সম্ভাবনার বাংলাদেশকে। দেশ-বিদেশে আমাদের একটা অবস্থান ও মর্যাদার জায়গা তৈরি হয়েছে। এই জায়গাটুকু ধরে রাখতে হবে। বুঝতে হবে সময় আমাদের পেছনে ছোটে না। আমরা ছুটে চলি সময়ের পেছনে। ঘড়ির কাঁটায় বেঁধে থাকা জীবনে আবেগ, বিবেক, মূল্যবোধ যেন হারিয়ে না যায়। আধুনিক ডিজিটাল নয় মানবিক হতে হবে। মাঝে মাঝে সামাজিক গণমাধ্যমে অনেকের ব্যক্তিগত মতামত, মন্তব্য, অপরের কুৎসা রটনা দেখে ঝাঁকুনি খাই। কী করে সম্ভব? এই স্বল্পজীবনে মানুষকে এত ভয়ঙ্কর কেন হতে হবে? কাছ থেকে জীবন-মৃত্যু দেখেছি। মৃত্যুর হিমশীতল পরশ ছুঁয়ে দেখেছি। পরে মনে হয়েছে বেঁচে থাকা অনেক আনন্দের। ২০০১ সালের মাঝামাঝি বেলজিয়াম গিয়েছিলাম। আমরা ছিলাম বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরসঙ্গী। এটিএন বাংলার চেয়ারম্যান মাহফুজুর রহমান ও আমি ছিলাম একসঙ্গে। ব্রাসেলস থেকে মাহফুজ ভাই চলে এলেন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ঢাকায়। আমি আবার লন্ডনে ফেরার সিদ্ধান্ত নিই। পেয়ে গেলাম সঙ্গীও। লন্ডন প্রবাসী কয়েস ভাই তখন কিং ফিশারে বড় কর্তা। তিনি গাড়ি নিয়ে ব্রাসেলসে এসেছিলেন। তার সঙ্গে সিলেটের মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ। এখন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক। আমার সঙ্গে আরও দুই সাংবাদিক। তারাও ঢাকায় ফেরেননি। সিদ্ধান্ত হলো লন্ডন যাওয়ার পথে আমরা আমস্টারডাম যাব। রাতে কিছুক্ষণ আমস্টারডাম কাটিয়ে ভোরে রওনা হব লন্ডনের পথে। লন্ডনে আসার পথে মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছিলাম হাইওয়েতে। গাড়ি চালাচ্ছিলেন কয়েস ভাই। সামনের আসনে বসা মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ। পেছনে আমরা তিন সাংবাদিক। ক্যামরাম্যান পল্লব এবং অবজারভারের আশরাফ ভাই। মহাসড়কে সবার চোখ ঘুম ঘুম। এ মাঝে হঠাৎ একটা তীব্র ঝাঁকুনি। খেয়াল করলাম আমাদের গাড়ি মূল সড়ক ছেড়ে উঠে যাচ্ছে আইল্যান্ডের দিকে। মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ ও আমি চিৎকার করে উঠলাম। আমাদের চিৎকারে হুঁশ হলো কয়েস ভাইয়ের। তিনি প্রাণপণ চেষ্টা করছেন গাড়ি নিয়ন্ত্রণের। ব্রেক কষলেন হাইওয়েতে। পেছনের গাড়ি আমাদের দেখতে পাচ্ছিল। এ কারণে পেছনের গাড়ি ছিল সতর্ক। কিন্তু তার পেছনের শতাধিক গাড়ি একটি আরেকটিকে ধাক্কা মারল। আমাদের গাড়িও চুরমার হয়ে যায়। আল্লাহর রহমতে আমাদের কারও কিছু হলো না। বেঁচে গেলাম। জীবনে বেঁচে থাকার একটা আনন্দ অনুভব করলাম। চলার পথে এ ঘটনা এখনো মনে দাগ কেটে আছে। একইভাবে আরেকবার ভয়াবহ দুর্ঘটনায় পড়েছিলাম কুমিল্লার নাঙ্গলকোটে যাওয়ার পথে। এক জনসভায় যাচ্ছিলেন আওয়ামী লীগের তখনকার সহ-প্রচার সম্পাদক আবদুল মান্নান। তখন প্রচার সম্পাদক ছিলেন মোহাম্মদ নাসিম। ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়ে ছাড়িয়ে উঠলাম লাকসাম সড়কে আমরা। কিছুদূর যাওয়ার পরই আমাদের গাড়ি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলল। বুঝতে পারছিলাম আমরা মৃত্যুর খুব কাছাকাছি। কারণ নিচে ডোবা। ড্রাইভার ডোবাতে পড়া রক্ষা করতে ধাক্কা মারে গাছে। গাড়ি ভেঙে যায়। আমরা বেঁচে যাই। জীবন অনেক সুন্দর। এই সুন্দরকে ধরে রাখতে হলে জগতে বদলাতে হবে মানসিকতা। চিন্তায় পরিশীলতা আনতে হবে। আলো ঝলমলে পৃথিবী দেখতে হলে মানুষকে বদলাতে হবে। সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন।
লেখক : সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।