ছাত্র যেভাবে ইয়াবা ব্যবসায়ী
প্রকাশিতঃ ৮:৩৮ অপরাহ্ণ | জুন ২৭, ২০১৮

কলেজ ছুটির পর বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে প্রথম সিগারেটের স্বাদ নিয়েছিল হাদি (ছদ্মনাম)। স্কুলজীবনেই তার বেশ কয়েক বন্ধুকে সে সিগারেট হাতে দেখলেও হাদিকে কখনো তা টানেনি। কলেজে ওঠেই এই হাদি যেন চেইন স্মোকার। কখনো মার্কেটের বারান্দায়, কখনো রাস্তার ধারে। দল বেঁধে আড্ডা আর সিগারেট টানা। তখন হাদি ফার্মগেটের বেসরকারি একটি কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র। এক আড্ডায় তাদের এক বন্ধু নতুন ক্যারিশমা দেখায়। সিগারেট থেকে তামাক বের করে খালি করে নেয়। এরপর পকেট থেকে কাগজের পোটলা বের করে। পোটলায় ছিল গাঁজা। সিগারেটের ভিতর গাঁজা ভরে নেয়। এরপর একজন একজন করে সেই গাঁজা টানতে শুরু করে। প্রথম দিন হাদির খুব খারাপ লাগলেও পরে তার খুব ভালো লেগে যায় এই নেশা। কিন্তু সেই গাঁজার পর সে চলে যায় সোজা ইয়াবা সেবনে। ইয়াবায় আসক্ত হওয়ার পর থেকে হাদির চলাফেরা বেড়ে যায়। চষে বেড়ায় ঢাকার এক মাথা থেকে আরেক মাথা পর্যন্ত। ইয়াবায় আসক্ত এই হাদি একসময় পরিণত হয় ইয়াবা ব্যবসায়ীতে। শান্ত স্বভাবের হাদি যে দিনে দিনে ভিন্ন হাদিতে পরিণত হচ্ছিল, তার বাবা-মা ঘুণাক্ষরেও টের পাননি। টের যেদিন পেলেন তখন আর তাদের কিছুই করার ছিল না। হাদির পরিচয় তখন ইয়াবা ব্যবসায়ী হিসেবে। ইয়াবাসহ পুলিশের কাছে ধরা পড়ার পর তালিকাতেও তার নাম উঠে গেছে। পুলিশের কাছ থেকে প্রথম জানতে পারেন হাদির গার্মেন্ট ব্যবসায়ী বাবা।
বন্ড দিয়ে পুলিশের কাছ থেকে ছেলেকে নিয়ে যায় তার বাবা। এরপর হাদিকে পাঠানো হয় পুনর্বাসন কেন্দ্রে। সেই হাদি দীর্ঘ চিকিৎসার পর সুস্থ হয়ে ওঠে। নিজেকে পাল্টে ফেলেছে। সেই অন্ধকার দিনগুলো তিনি মনে করতে চান না। হাদি এখন লেখাপড়া করছেন বিদেশে। তিনি জানিয়েছেন ইয়াবা ব্যবসায়ী হয়ে ওঠার নানা কথা।
হাদি জানায়, এগুলো পাওয়া খুব ইজি। হোয়াটসঅ্যাপে গ্রুপ আছে, ফেসবুকে গ্রুপ আছে, ইমোতে গ্রুপ আছে, ভাইবারে গ্রুপ আছে। সব গ্রুপেই ইয়াবা বিক্রি চলছে। সেখানে নানা আলোচনা হয়। নেশার টাকা জোগাড় করা এক সময় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায় তার কাছে। ঘর থেকে টাকা চুরি, গয়না চুরি করি। পরিবার সতর্ক হয়। ভাবে কাজের লোকজন হয়তো চুরি করেছে। আমাকে সন্দেহ করত না। তখন টাকার জন্য ছিনতাই করেছি। গার্মেন্টস কর্মী থেকে শুরু করে দলবল নিয়ে ফিল্মি স্টাইলে ছিনতাই করে নেশার টাকা জোগাড় করেছি। কিন্তু এগুলো আমি ওভারকাম করেছি। আমার স্বীকার করতে লজ্জা নেই। কারণ আমি এগুলো ওভারকাম করে এসেছি। আমি আমার বাবার মানসম্মান ডুবিয়েছি। প্রতিদিন ঘরে চুরি করছি লাখ লাখ টাকা। একদিন ধরা পড়ে যাওয়ার পর আমার মা অনেক কান্না করেছেন। বলেছেন তিনি, বাবা তুই আমার কাছে না চেয়ে ব্যাগ থেকে চুপি চুপি কেন টাকা নিচ্ছিলি। জবাব দিতে পারিনি। অ্যাডিক্ট ছিলাম বলে বুঝিনি। এখন বুঝি। যে কী করেছি, কতটুক ছোটলোক বা নিকৃষ্ট ব্যক্তি ছিলাম আমি!”
নেশার খপ্পরে পড়ে একপর্যায়ে ইয়াবার ব্যবসায়ী হয়ে ওঠেন হাদি। প্রথমে বন্ধুদের ইয়াবা জোগাড় করার দায়িত্ব নিল সে। সবার কাছ থেকে ৫০ টাকা বেশি নিলেই নিজের একটার দাম উঠে আসত। এভাবেই শুরু। এতে মজা পেয়ে যান হাদি। একদিন এক ডিলার ১০ হাজার পিস ইয়াবা দেয় হাদির হাতে। এক রাতেই সব বিক্রি করে চমকে দেন তিনি। মহিলাদের দিয়ে ইয়াবা সরবরাহের কাজ করতেন। সবার সঙ্গে সুসম্পর্ক হাদির খুব কাজে লাগে। এলাকার অলিগলি সব চেনা। সেটিও ছিল তার অনুকূলে। হাদি জানায়, আমি আসলে বন্ধু-বান্ধব চিনতে ভুল করেছি। বাবা-মা আমাকে বিশ্বাস করতেন। আমি তাদের কাছ থেকে প্রচুর টাকা নিতাম। তারা কোনো কথা ছাড়াই আমাকে টাকা দিয়েছেন। বিভিন্ন অজুহাত দেখাতাম। কিন্তু কত টাকা আর দিবে। আমিই বা কত টাকা চাইব। আমার যায়গায় অন্য কেউ হলে তাকে হয়তো মরতে হতো, অন্যথায় জেলখানায় পচতে হতো। তাই এ পথে যেন কেউ না যায়। এটাই থাকবে আমার অনুরোধ সবার কাছে। বর্তমানে মাদকের বিরুদ্ধে বিশেষ অভিযান সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে তিনি বলেন, পুলিশ প্রশাসন যদি জড়িত না থাকে বাংলাদেশে এই মাদক বিক্রি করা অসম্ভব। পুলিশকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, মাদক ব্যবসা চলবে না। তবেই সম্ভব বন্ধ করা চিরদিনের জন্য।
সূত্র: সাবধান বাংলাদেশ পর্ব: ৯৩, বাংলাদেশ প্রতিদিন।