|

সবাই চান এমপি হতে

প্রকাশিতঃ ১০:২৭ পূর্বাহ্ণ | অক্টোবর ২৪, ২০১৮

জুলকার নাইন: আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এমপি হতে চান সবাই। নির্বাচনী এলাকায় কোনো অবস্থান না থাকলেও প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর অফিসে তারা ভিড় জমাচ্ছেন। অনেকে আবার এলাকায় গিয়ে দু-চার জন আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে ঘুরে সামাজিক মাধ্যমে ছবি তুলে দিচ্ছেন প্রার্থী হিসেবে। এদের অনেকে জীবনে রাজনীতি করেননি, এমনকি কারও কারও চৌদ্দপুরুষের কারও রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ততা নেই। তার পরও ‘এমপি হতে চাই’ পোস্টার দিয়ে সয়লাব করে ফেলছেন রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশ। জানা গেছে, মুদি দোকানদার, ফুটপাথের ব্যবসায়ী থেকে বড় ব্যবসায়ী পর্যন্ত লবিং শুরু করেছেন এমপি হতে। আবার চতুর্থ গ্রেডের শোবিজ তারকা থেকে অনেক নামিদামি অভিনেতা-অভিনেত্রী, গায়ক-গায়িকা নিজেদের প্রার্থী হিসেবে প্রচার শুরু করেছেন। দেখা যাচ্ছে, সবচেয়ে বেশি এমপি হতে আগ্রহী আওয়ামী লীগ থেকে। ঠিকানাবিহীন বেশির ভাগ মানুষই সরকারি দলের নেতা ও নেত্রী ভাব নিয়ে ঘোরাফেরা করছেন বিভিন্ন স্থানে। এদের উৎপাতে আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতা-কর্মীরা অতিষ্ঠ। আওয়ামী লীগের একজন সিনিয়র নেতা সেদিন বললেন, ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার পদে দাঁড় করালে ১০টা ভোট পাবে না, অথচ এলাকায় সে প্রচার করছে এমপি প্রার্থী! জীবনে ছাত্রলীগ, যুবলীগ বা আওয়ামী লীগ কোনোটাই করেননি, অথচ এখন ভাব দেখাচ্ছেন তারাই আওয়ামী লীগ চালাচ্ছেন। হাওয়া ভবনে ঘোরাঘুরি করেছেন এমন কেউ কেউ দাদা-নানার নাম ভাঙিয়ে এখন আওয়ামী লীগের প্রার্থী হতে চাইছেন। এদের কেউ কেউ রহস্যজনকভাবে প্রধানমন্ত্রীর বিভিন্ন অনুষ্ঠানেরও পাস নিয়ে নিজেদের শোডাউন করেন, যার বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়ে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের ওপর। কারও কারও এলাকায় বাড়িঘরও নেই, কিন্তু ঢাকায় আওয়ামী লীগ অফিসের চারদিকে পোস্টার দিয়ে নিজেকে প্রার্থী ঘোষণা দিয়ে চলেছেন। অনেকে ভাবছেন ২০১৪ সালের মতো একটি নির্বাচন হবে এবং সেখানেই বাজিমাত করবেন তারা। ভোট ও রাজনীতির বাস্তবতা সম্পর্কে অনেকের ধারণাও নেই। তবু তারা প্রার্থী। তাদের পোস্টার আর হাঁটাচলায় বিশাল ভাব তৈরি হয়েছে।

শুধু আওয়ামী লীগ নয়, একই চিত্র অন্য দলগুলোতেও। কিছুদিন ধরে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান, মহাসচিবসহ বিভিন্ন নেতার কাছেও ভিড় জমাচ্ছেন বারো রকমের প্রার্থী। কেউ কেউ টাকার দাপটও দেখান। আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টিতে প্রতিযোগিতায় নারী প্রার্থীরাও পিছিয়ে নেই। তবে বিএনপির চিত্র একটু আলাদা। তাদের মধ্যে একটি আসনে আট-দশ জন করে প্রার্থী থাকলেও প্রকাশ্য শোডাউন কম। মামলার ভয়ে অনেকে এলাকাছাড়া। তাই তাদের প্রার্থীরা এখন ব্যস্ত শুধু লবিং নিয়ে। এ লবিং শুধু ঢাকায় নয়, লন্ডনেও গড়িয়েছে। সেখানেও রয়েছে বারো রকমের ভিড়। এ ছাড়া ছোটখাটো দলগুলোর মধ্যেও ভিড় কম নয়। জোটের কাছ থেকে কে কত আসন নিতে পারছে তার দিকেই দৃষ্টি এই উড়ে এসে জুড়ে বসা প্রার্থীদের। কেউ কেউ আবার সদ্যগঠিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ড. কামাল-মান্নাদের সঙ্গেও যোগাযোগ রাখছেন। জানা যায়, এমপি হওয়ার লাইনে থাকাদের মধ্যে রয়েছেন প্রায় সব পেশার মানুষই। শোবিজ তারকা, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, শিক্ষক, আইনজীবী, ব্যবসায়ী, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা, সাবেক পুলিশ অফিসার— কে নেই এ লাইনে। সবচেয়ে বেশি রয়েছেন গার্মেন্ট ব্যবসায়ী। এমপি টিকিট পাওয়ার দৌড়ে মাঠে নেমেছেন অর্ধশতাধিক গার্মেন্ট ব্যবসায়ী। ছড়াচ্ছেন কাঁচা টাকাও। আগে বিএনপির মনোনয়ন চাওয়া ব্যবসায়ীকে এবার নৌকার মনোনয়ন চেয়ে পোস্টার ছাপিয়ে ও বিশালাকার নৌকা বানিয়ে শোডাউন করতে দেখা যাচ্ছে। অর্থ উপার্জনের পর তাদের টার্গেট একবার হলেও এমপি হওয়া। টাকার জোরে সব সম্ভব মনে করেই তাদের পথচলা। কয়েক শ প্রবাসী নির্বাচনে মনোনয়ন পাওয়ার দৌড়ে শামিল হতে দলে দলে দেশে এসেছেন। এমনও আছে— ১৮ বছরে যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশে আসেননি, কিন্তু এবার এসেছেন উত্তরাঞ্চলের একটি আসনের প্রার্থী হতে। ইউরোপ আওয়ামী লীগ-বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতার সিলেট অঞ্চলে প্রার্থী হওয়ার বিষয় নতুন না হলেও এবার যেন এ লাইন আরও বড় হয়েছে। এরও বেশির ভাগেরই ভরসা অর্থ। এমপি হতে চাওয়াদের মধ্যে আরেকটি বড় অংশ সাবেক সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী। আগে মধ্যম সারির পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন, এখন এমপির খাতায় নিজের নাম লেখাতে ইচ্ছুক এমন পোস্টারও আছে ধানমন্ডি আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের পাশে। শোবিজ জগতের কয়েক ডজন পরিচিত-অর্ধপরিচিত তারকা হতে চান জনপ্রতিনিধি। আওয়ামী লীগ-বিএনপি জোটের ছোট দলগুলো থেকে প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা আছে কয়েকজনের। আসন্ন নির্বাচনে অন্তত ৫০ জন চিকিৎসক এমপি প্রার্থী হতে মাঠে নেমেছেন। এর বেশির ভাগেরই এলাকায় তেমন কোনো রাজনৈতিক যোগাযোগ না থাকলেও এখন সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে জনগণ ও নেতা-কর্মীদের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছেন। সেই সঙ্গে শক্ত লবিং করছেন কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সভাপতি ও ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) সাবেক চেয়ারম্যান হাফিজউদ্দিন খানের মতে, ‘বাংলাদেশে সবকিছুই এখন ক্ষমতাকেন্দ্রিক। সবাই এখন ক্ষমতা চায়। যারই কিছু অর্থ ও পরিচিতি হয়েছে সে-ই ক্ষমতা পেতে মরিয়া হয়ে। আর যেহেতু ক্ষমতার নিয়ন্ত্রক হন স্থানীয় এমপিরা তাই সবারই আগ্রহ এমপি হওয়া। অর্থ ও ক্ষমতালিপ্সুরা মনে করেন একবার এমপি হতে পারলেই নিজের প্রতিপত্তিকে নতুন মাত্রা দিতে পারবেন। এতে জনগণের বা এলাকার কী উন্নয়ন হবে তা এসব নেতার কেউ ধর্তব্যের মধ্যে আনেন বলে মনে হয় না।’

সুত্র: বাংলাদেশপ্রতিদিন।

Print Friendly, PDF & Email