|

শওকত আলীর পুড়ে যাওয়া মোটরবাইক এবং আইনের প্রয়োগ

প্রকাশিতঃ ৮:০৫ অপরাহ্ণ | সেপ্টেম্বর ২৮, ২০২১

নিজামুল হক বিপুলঃ

ঢাকার রাস্তায় একটি মোটর বাইক পুড়িয়ে ফেলেছেন একজন বাইকার। ঘটনাটি ঘটেছে গত সোমবার (২৭ সেপ্টেম্বর) দুপুরে। ঘটনাস্থল বাড্ডা লিংক রোড। বাইকটি পুড়িয়েছেন বাইকের মালিক শওকত আলী। তিনি নিজেই নিজের বাইকে আগুন দিয়েছেন।

কিন্তু কেন?

এই কেন এর উত্তর নিজেই দিয়েছেন শওকত আলী। আমি শুধু বিষয়টাকে আরেকটু বড় পরিসরে পাঠকের সামনে তুলে ধরতে এবং কিছু প্রশ্নের জবাব খুঁজতে লেখাটি লিখলাম।

শওকত আলী ছিলেন একজন ব্যবসায়ী । কেরানাীগঞ্জে তার একটি স্যানিটারি পণ্যের দােকান ছিল। সেই ব্যবসার আয়ে ভালোই চলছিল তার সংসার। কিন্তু অতিমারী করোনা তার সেই দোকানকে উচ্ছেদ করে দিয়েছে। ব্যবসায় ধ্বস নামার কারণে মাস কয়েক আগেই তিনি বেকার হয়ে যান। তাই বলে সংসারের খরচ তো আর থেমে নেই। পেটে তো আর খিল দিতে পারেননি। তাই বাধ্য হয়ে পেটের তাড়নায় গত দুই-তিন মাস ধরে ভাড়ায় মোটর সাইকেল চালিয়ে সংসারের ব্যয় নির্বাহ করছিলেন।
এটা যেন সহ্য হচ্ছিল না কারও কারও। কারণ শওকত শেয়ারিং অ্যাপ ব্যবহার না করে চুক্তিতে যাত্রী পরিবহন করছিলেন। তাই নানা অজুহাতে তিনি আইনী ঝামেলায় পড়ছিলেন।
বার বার আইনী ঝামেলায় পড়ে তাকে মোটা অংকের জরিমানাও পরিশোধ করতে হয়েছে। কিন্তু এবার আর তিনি জরিমানা পরিশোধে রাজি নয়, একেবারে নিজের উপার্জনের একমাত্র অবলম্বন বাইকটিকেই প্রকাশ্যে রাস্তায় আগুন ধরিয়ে ছুটি দিয়ে দিলেন। ঘটনাটি সত্যিই দুঃখজনক। বেদনাদায়ক।

শওকতের অভিযোগ, গত সপ্তাহেই পুলিশ তার বিরুদ্ধে একটা মামলা দিয়েছে রাইড শেয়ারিং অ্যাপ ব্যবহার না করে চুক্তিতে যাত্রী নেয়ার অভিয়োগে। এবার যখন পুলিশ তার বিরুদ্ধে মামলা দিবে বলছিল, তখন তিনি রাগে ক্ষোভে নিজের বাইকে নিজেই আগুন দেন।

অবশ্য ট্রাফিক পুলিশের দাবি ”অফিস আওয়ারে গুলশানের লিংক রোডে অনেক যানজট হয়। তখন মোটরসাইকেলগুলো রাস্তার পাশে দাঁড় করিয়ে রাখলে গাড়ি চলাচলে প্রতিবন্ধকতার তৈরি হয়। এজন্য দায়িত্বরত সার্জেন্ট কয়েকজন মোটরসাইকেল চালকের কাগজপত্র নিয়ে নেন। কয়েকজনকে মামলা দেয়া হলেও শওকত আলীকে মামলা দেয়ার আগেই তিনি নিজের গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছেন।”

পুলিশের বক্তব্যটি যৌক্তিক, তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু এই যৌক্তিক বক্তব্যটি যদি সর্বক্ষেত্র প্রযোজ্য হত, যদি আইন সবার ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রয়োগ হত- তাহলে হয়ত শওকতকে তার এই সময়ের একমাত্র আয়ের উৎসকে নিজের হাতে পুড়িয়ে ফেলতে হত না।

আমাদের দেশে আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে বরাবরই একধরণের স্বজনপ্রীতির অভিযোগ আছে। আইন ক্ষেত্র বিশেষ দুর্বলের বিপক্ষেই প্রয়ােগ হয় সচরাচর। সবল, ক্ষমতার জোর আছে, মামু-খালু, চাচা, দুলাভাইয়ের ক্ষমতার দাপুট আছে, এমন লােকজনদের ক্ষেত্র আইন একেবারেই অসহায়। আর আইনের লোকজন যখন আইন ভঙ্গ করে তখন তো আইন শিকেয় উঠানো থাকে।

গত কয়েক বছরে নিজে ঢাকার সড়কে গাড়ি চালাতে গিয়ে এরকম বহু অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছি। এই তো বছর খানেক আগে গণভবনের দিক থেকে লেক রোড দিয়ে বিজয় সরণীর দিকে যাচ্ছিলাম। বিজয় সরনী সিগন্যালে দাঁড়াতেই তরুণ বয়সি একজন সার্জেন্ট আসলেন। গ্লাস নামাতেই বললেন, আপনি আইন ভঙ্গ করেছেন। দু’টি অপরাধ করেছেন। আমি কিছুটা হতবাক হলাম। জানতে চাইলে বললেন, এই সড়কে (লেক রোড) ৪০ কি.মি এর বেশি গতিতে গাড়ি চালানো নিষেধ। দ্বিতীয় তো আপনি রং সাইটে ওভারটেক করেছেন।
আমি বললাম, ভুল হয়ে গেছে। এরপর তরুণ সার্জেন্ট ভদ্রভাবে আমাকে কিছুটা জ্ঞান দিয়ে ভবিষ্যতে সতর্ক হওয়ার কথা বলে চলে গেলেন। এ যাত্রায় হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম।

কিন্তু একই সময়ে আমি দেখলাম আরো অনেকগুলো গাড়ি আইন অমান্য করেছে। তাদের কাছে সার্জেন্ট যাননি। কেন জানি আমাকেই তার পছন্দ হয়েছিল।

আরেকবার আমি ইন্সুরেন্সের কাগজ নিয়ে বের হইনি। (কারণ আগের দিনই ইন্সুরেন্স রিনিউ করেছিলাম, তাই কাগজ বাসায় রেখেই বের হয়েছিলাম) মানিক মিয়া এভিনিউতে পুলিশ আমাকে আটকাল। বললাম, কাগজটি ভুলে ফেলে এসেছি। অনুরোধ করলাম, মামলা দিয়েন না। প্রয়োজনে ১০ মিনিটের মধ্যে আমি কাগজ এনে আপনাকে দেখাব। কিন্তু সার্জেন্ট সাহেব সেটি মানতে নারাজ। অনেক অনুরোধের পরও তিনি মামলা দিলেন এবং গাড়ির কাগজ নিয়ে গেলেন। আমি বিকেলই জরিমানার টাকা পরিশোধ করলাম। কিন্তু কাগজ ফেরত পেতে আমাকে প্রচুর ভোগান্তি পোহাতে হয়েছিল।

এরকম আরও অনেক অভিজ্ঞতা আছে। পুলিশ কোন কারণে আমাকে আটকালে আমি কখনও আমার পেশাগত পরিচয় দেই না। কারণ আমি পুলিশের আচরণটা দেখতে চাই।

এবার মূল প্রসঙ্গে ফেরা যাক। শওকত আলী আইন হয়ত ভঙ্গ করেছেন। কিন্তু তাকে সুযোগ দেয়া উচিত ছিল। তিনি যে মামলা না করার অনুরোধ করেছিলেন, মানবিক কারণে তার এই অনুরোধে সাড়া দেয়া উচিত ছিল।

ট্রাফিক পুলিশের কর্মকর্তারা তো মামলা দেন নিজেদের টার্গেট পূরণ করতে। যদি তারা সত্যি সত্যি আইনের প্রয়োগ করতেন তাহলে রাজধানীর সড়কে এতাে এতো জঞ্জাল থাকত না। রাজধানীর প্রতিটি ব্যস্ত সড়কে যত্রতত্র গণপরিবহন (বাস, মিনবাস, বিআরটিসি’র বাস) দাঁড় করিয়ে যেভাবে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হয় তার বিরুদ্ধে খুব কমই আইনী পদক্ষেপ নিতে দেখা যায় ট্রাফিক পুলিশকে। এসব ক্ষেত্রে যদি আইনের যথাযথ প্রয়োগ তাহলে সড়কে যেমন শৃংখলা থাকত, তেমনি যানজটও কমে আসত।

শুধু যে শওকত আলীদের মোটর সাইকেল সড়কে যানজট তৈরি করে তা কিন্তু নয়। যানজট তৈরির পেছনে আরও বহু কারণ আছে। যেমন ঢাকা শহরে চালকরা লেন মানেন না।
কিন্তু এই অপরাধ ঠেকাতে কোন উদযোগ দেখা যায় না। বাসগুলো নির্দষ্ট স্থানে/স্টপেজে দাঁড়ায় না। এটা বড় ধরণের অপরাধ। উল্টো পথে গাড়ি চলে হরহামেশা। কিন্তু এসব অপরাধের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেয়া হয় না, সেই জবাব পাওয়া কঠিন।

এগুলো নিয়ন্ত্রণ না করে, জীবনযুদ্ধে থাকা শওকত আলীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে রাজধানীর যানজট কমবে না। আইনেরও যথাযথ প্রয়োগ হবে না।

লেখকঃ গণমাধ্যমকর্মী।

Print Friendly, PDF & Email