গফরগাঁওয়ে ট্রেন থেকে হারেয়ে যাওয়া সাজেদা ৪০ বছর পর নেদারল্যান্ড থেকে ফিরেছে নিজগ্রামে
প্রকাশিতঃ ৯:৫৮ অপরাহ্ণ | জুলাই ১৭, ২০১৮

আজাহারুল হক, গফরগাঁও: সংসারে নিত্য অভাব-অনটন স্নেহ-ভালবাসা মানে না। খাওয়ানো-পড়ানোর কষ্টে ৪০ বছর আগে গফরগাঁও রেলস্টেশনে অপেক্ষমাণ ট্রেনের ভেতর দুই শিশুকন্যাকে ফেলে রেখে আসেন এক দম্পতি। তারপর থেকে শিশু দুই বোন হারিয়ে যায়। হতভাগ্য এই দুই কন্যাশিশুর নাম সাজেদা ও মল্লিকা।
৪০ বছর পর ছোট মেয়ে সাজেদা ফিরে এসেছে বাবার বাড়িতে। ফিরে পেয়েছে আপনজনদের। শুধু নেই সেই বাবা-মা। যে বাবা-মা তাদেরকে নিত্য অভাব আর অনটনের কারণে বুকে পাথর বেঁধে ফেলে রেখে এসেছিল ট্রেনে।
ভাগ্যের বিড়ম্বনায় ট্রেন থেকে মাতৃসদন, সেখান থেকে দুই শিশুর আশ্রয় মেলে নেদারল্যান্ডসের দুই দম্পতির ঘরে।
গতকাল সোমবার (১৬ জুলাই) সাজেদা নেদারল্যান্ডসের নাগরিক স্বামী থমাস ও দুই পালিত কন্যা আজিয়া ও মুনকে নিয়ে ইত্যাদির একটি টিমের সহযোগিতায় গফরগাঁও উপজেলার রাওনা ইউনিয়নের খারুয়া মুকন্দ গ্রামের জন্ম ভূমিতে আসেন।
পরিবারের ভাষ্য, ১৯৭৮ সালে তখন তাদের বয়স ছিল ৬-৭ বছরের মতো। অভাবের সংসারে তাদের খাবার যোগানোর সুযোগ হয়নি বাবা-মায়ের। ফলে বাধ্য হয়ে হতভাগ্য দুই মেয়েকে বাবা-মা তাদের ট্রেনের ভেতর ফেলে রেখে আসেন। পরে ট্রেনটি গাজীপুরের টঙ্গী স্টেশনে যাত্রা বিরতিকালে দুই শিশুর কান্নার আওয়াজ শুনে স্থানীয় এক ব্যক্তি তাদের দত্তপাড়ায় অবস্থিত একটি মাতৃসদনে ভর্তি করে দেন। সেখানে কেটে যায় দুই বছর। দুই বছরে তারা বাড়ির কোনো কথাই মনে করতে পারেনি। পরে ১৯৮০ সালে নেদারল্যান্ডসের এভার্ট বেকার ও মেরিয়ান্ট রেজল্যান্ড দম্পতি তখন বাংলাদেশ সফর করছেন। তারা টঙ্গীর ওই মাতৃসদন থেকে শিশু মল্লিকাকে দত্তক নেন। পরে ওই দম্পতির মাধ্যমেই নেদারল্যান্ডসের আরেকটি পরিবার মল্লিকার ছোট বোন সাজেদাকে দত্তক নিয়ে যায়। সেখানেই সাজেদা ও মল্লিকা বেড়ে ওঠেন।
নেদারল্যান্ডসের এক নাগরিক থমাসের সাথে বিয়ে হয় সাজেদার। তাদের সুখের সংসারে রয়েছে দুই কন্যাসন্তান। দত্তক নেয়ার সময় দুই বোনের মাতৃভূমি বাংলাদেশ, দত্তক নেয়া পরিবার এ খবর জানলেও প্রকৃত পরিচয় তাদের জানা ছিল না। পরে বেশ কয়েকবার বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে তারা মা-বাবার সন্ধান করে ব্যর্থ হন।
এছাড়াও তিনি প্রতিবারই বাংলাদেশে এসে তার শিকড়ের সন্ধানে টঙ্গী ও আশপাশের এলাকায় পোস্টারিং করে এবং দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগাযোগ করেন। প্রতিবারই ব্যর্থ হয়ে ফিরে যান। এ বছর জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশে এসে বাবা-মা, স্বজনদের খোঁজে ব্যর্থ হয়ে অবশেষে যোগাযোগ করেন ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ইত্যাদির পরিচালক হানিফ সংকেতের সাথে। গত ৩০ মার্চ এ সংক্রান্ত একটি মর্মস্পর্শী প্রতিবেদন বিটিভির জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ইত্যাদিতে প্রচারিত হয়। এছাড়াও বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। অনুষ্ঠানটি দেখেন খারুয়া মুকুন্দ গ্রামের দলিল লেখক শ্যামল কুমার দত্ত। তিনি ইত্যাদির পচিালক হানিফ সংকেতের সাথে যোগাযোগ করে আনোয়ারার ভাই ছুতু মিয়া (৫৫) এবং ছুলেমান নেছার (৬০) ডিএনএ রিপোর্ট নেদারর্যান্ডস পাঠান। আনোয়ারা বেগম নিশ্চিত হন ছুতু মিয়া ও ছুলেমান নেছাই তার ভাই, বোন। এরই মধ্যে গফরগাঁও থেকে যোগাযোগ করেন সাজেদা ও মল্লিকার স্বজনরাও। তাদের আবেদনে ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে সাজেদা ও মল্লিকার পরিচয় উন্মোচিত হয়।
সাজেদা নেদারর্যান্ডসে নার্সিং-এ স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে একটি হাসপাতালে সেবিকার কাজ করেন।
গতকাল সোমবার সাজেদা নেদারল্যান্ডসের নাগরিক স্বামী ও দুই কন্যাসন্তান নিয়ে ইত্যাদির একটি টিমের সহযোগিতায় গফরগাঁও উপজেলার রাওনা ইউনিয়নের খারুয়া মুকন্দ গ্রামের জন্মভূমিতে আসেন। এ সময় এক আবেগঘন অবস্থার সৃষ্টি হয়।
এ সময় বড় বোন সলেমন নেসা ও ভাই ছুতু মিয়া হারিয়ে যাওয়া বোনকে জড়িয়ে ধরে বলেন, ৪০ বছর পর বোন ফিইরা আইছে। এতদিন ভাবছিলাম বোনডা আমাদের মইরা গেছে। ওরে পাইয়া এখন কইলজাডা ঠাণ্ডা অইয়া গেছে। তবে এখন আর বাংলা বলতে পারেন না সাজেদা। পরে সাজেদা তারা বাবা-মার কবর জিয়ারত করেন।
এখন আত্মীয়-স্বজন ও আশপাশের গ্রামের হাজারো মানুষ দুদিন ধরে সাজেদাকে দেখতে আসছে। তাদের পরিবারে যেন এখন উৎসবের আমজ বইছে।
কথা বলতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন সাজেদার ভাই ছুতু মিয়া। তিনি বলেন, বহুত বছর পর বোনেরে পাইছি। কিন্তু আব্বা আর বোনেরে দেখে যেতে পারল না। আব্বা বেঁচে থাকলে এহন সবচেয়ে বেশি খুশি হতেন।
রাওনা ইউপি চেয়ারম্যান সাহাবুল আলম বলেন, সাজেদার আগমনে সারা গ্রামে এখন আনন্দের জোয়ার বইছে। তাকে দেখার জন্য প্রতিদিন শত শত মানুষ ভিড় করছে।