ভালুকার ‘মল্লিকবাড়ী মোড়’ কেন – ‘বাটারফ্লাই মোড়’? ফেইসবুকে তোলপাড়!
প্রকাশিতঃ ৪:৩৮ অপরাহ্ণ | জুন ১৪, ২০১৯

দীন মোহাম্মদ দীনু:
“যখন তোমার কেউ ছিলোনা
তখন ছিলাম আমি,
এখন তোমার সব হয়েছে,
পর হয়েছি আমি।”
ছন্দের যাদুকর শব্দ বিন্যাসে অদ্বিতীয়৷ স্নেহের ছোট ভাই রেজাউল ইসলাম এর স্ট্যাট্যাসের শুরুটা এভাবেই ছিল। সে লিখেছে, “মল্লিক বাড়ী ভালুকা উপজেলার সর্বাধিক পরিচিত এবং জনপ্রিয় একটি ইউনিয়ন। বিশাল গরু-ছাগলের হাটের জন্য স্বনাম ধন্য এই বাজারের পাশাপাশি ইউনিয়নটাও আশে পাশে দু চার জেলার মানুষের কমবেশি চেনা জানা। ঢাকা -ময়মনসিংহ মহাসড়কে যে স্থানটি “মল্লিক বাড়ি মোড় ” নামে পরিচিত, তার আশ পাশটা মটকা ঝুড় ও অন্যান্য আগাছায় ভরপুর ছিল। মহাসড়ক থেকে রাস্তাটি মল্লিক বাড়ী বাজার পর্যন্ত বা বাজার ভায়া হয়ে অন্য কোথাও অতিবাহিত হওয়ায় মোড়টির পরিচয় দিতে গিয়ে স্থানীয় জনগনের “মল্লিক বাড়ি” নামের সাথে অত্র স্থানটির এক ” অলিখিত চুক্তির মতো” জনগনের মুখনিঃসৃত বানী ছিল ঐতিহাসিক “মল্লিক বাড়ি মোড়”। যার কোন সাইনবোর্ডের প্রয়োজন ছিলনা”।
ঢাকা -ময়মনসিংহ মহাসড়কে চলমান প্রায় সকল যাত্রী সাধারণ, ড্রাইভার,হেল্পার সবাই “মল্লিক বাড়ি মোড়” নামেই চিহ্নিত করে। সময়ে পরিবর্তনে আগাছা পরিষ্কার হয়ে গেল বলে আগত কোন প্রতিষ্ঠানের নামের সাইনবোর্ড লাগিয়ে স্থানটির নাম পরিবর্তন করার চেষ্টা করা নিজস্ব নামের ঐতিহ্যের সংগে প্রতারণা বা বেইমানী করারই শামিল। আপনার/আপনাদের উপজেলার একটি বৃহৎ বাজারকে সারা বাংলাদেশে পরিচিত করানোর এই সুযোগকে পদদলিত করা নিজের অস্তিত্বকে অস্বীকার করা ছাড়া আর কিছুইনা।
আপনাদের সু বুদ্ধির উদয় হোক।
জন্মভূমির ভালবাসায় উদ্দীপ্ত “রনী” ভাইয়ের আকুতি সবার হৃদয়ে সাড়া জাগুক।
সর্বোপরি ভালবাসার জয় হোক।
সবার জন্য শুভকামনা।শহীদ নাজিম উদ্দীন উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ এর শিক্ষক খসরু মোহাম্মদ রনির ফেইসবুক স্টেটাস সোস্যালমিডিয়ায় দুদিন ধরে তোলপাড়।
রনি লিখেছে ও আবেদন জানিয়েছে —-
“মল্লিক বাড়ী মোড় কেমনে বাটার ফ্লাই মোড় হইয়া গেলো বুঝলাম না, মাননীয় এমপি মহোদয়, উপজেলা পরিষদের সম্মানিত চেয়ারম্যান এবং প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষন করছি যেন জায়গাটির নাম মল্লিক বাড়ী মোড় নামকরন করা হয়, একটি ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের নাম না-হয়ে আমাদের ঐতিহ্যবাহী ইউনিয়ন মল্লিক বাড়ীর নামে যদি জায়গাটির নামকরন হয় তাহলে আমাদের এলাকার নামটি সারা বাংলাদেশের মানুষ জানবে এটুকুই আমাদের আনন্দ, সকলের অবগতির জন্য যানাচ্ছি যে জায়গাটির নাম মল্লিক বাড়ী মোড় নামে ইতিমধ্যে সকলের মাঝে পরিচিত তাই আমরা মল্লিক বাড়ী বাসী যার যার অবস্থান থেকে ভুমিকা পালন করার জন্য বিনীত অনুরোধ জানাচ্ছি”।
মুহুর্তেই রনির স্ট্যাটাসটি ভাইরাল হয়ে যায়, দল মত নির্বিশেষে সকলে সহমত পোষন করে কমেন্টস করতে থাকে, অনেকে শেয়ার করতে থাকে এবং কেউ কেউ অনুরূপ দাবি জানিয়ে স্টেটাস দিতে থাকে।এক পর্যায়ে নেট দুনিয়ার গন দাবিতে পরিনত হয় মল্লিকবাড়ী মোড় ছাড়া অন্য নাম মানি না, ছোট ভাই রেজাউল ইসলামের কমেন্টস এক ছন্দময় শব্দের মাধুর্য”।
শিক্ষক সাংবাদিক ও আইসিটি বিশেষজ্ঞ সামিউল লিখেছে, “ঢাকা-ময়মনসিংহ মহসড়কের ভালুকা অংশে ঐতিহ্যবাহী মল্লিকবাড়ি বাজারে যাওয়ার রাস্তার মোড়টি যুগ যুগ ধরে মল্লিকবাড়ি মোড় নামে সুপরিচিতি লাভ করে। যা কিনা এ মহাসড়কের সব গাড়ির চালক ও সহকারীরা চিনে। সম্প্রতি একটি কোম্পানী (বাটারফ্লাই) মল্লিকবাড়ি মোড়ে তাদের একটি বড় সাইনবোর্ড লাগিয়ে বাটারফ্লাই মোড় নামে এ মোড়টির নামকরণ করতে উঠে পড়ে লেগেছে। এলাকাবাসীর প্রশ্ন ১ টি কোম্পানী কিছুদিন আগে এখানে এসে ব্যাংকের কাছ থেকে লিজ নেওয়া জায়গায় কারখানা স্থাপন করে কী করে ঐতিহ্যবাহী নাম পরিবর্তনের চেষ্টা করছে? তাদের খুটির জোর কোথায়? মল্লিকবাড়ি বাংলাদেশের মধ্যে একটি ঐতিহ্যবাহী ইউনিয়ন। এ ইউনিয়ন থেকে ২ জন (আলহাজ্ব কাজিম উদ্দিন আহমদ ধনু ও মনিরা সুলতানা মনি) এমপি সংসদে এলাকাবাসীর প্রতিনিধিত্ব করছে। বাংলাদেশে আর কোন ইউনিয়নে ২ জন সংসদ সদস্য আছে বলে আমার জানা নেই।
আমি এ বিষয়ে মাননীয় সংসদ সদস্যসহ স্থানীয় প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। তাদের কাছে এলাকাবাসীর পক্ষে জোরালো দাবি জানাচ্ছি ঐতিহ্যবাহী মল্লিকবাড়ি মোড়ের নাম ঠিক রাখার জন্য এবং ‘বাটারফ্লাই মোড়’ সম্বলিত সাইনবোর্ডটি সরিয়ে ফেলতে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য”।
শিল্প সাহিত্যের অনুরাগী ও চাকুরিজীবী মো. শাহাবউদ্দিন তার দীর্ঘ স্ট্যাটাসে বিস্তারিত তথ্য বহুল লেখাটি ‘ইতিহাসের দলিল’ বললে ভুল হবে না। তিনি লিখেছেন, “বিষয়টি নিয়ে অনেকের আইডিতে লেখালিখি হচ্ছে । এই স্থানএক সময় গজারী ও মটকা বনে গেড়া ছিল।ঘন বনে অন্ধকার ছিল স্থানটি।বনের পাশেই অর্থাৎ রাস্তার পূর্ব পাশে উচু জায়গায়( বর্তমানে সমতল )নজর আলীর বাড়ী ছিল,তার ডাকনাম ছিল নউজ্জা। উনার নাম অনুসারে এই স্থান নউজ্জার বাড়ী বলে পরিচিত ছিল আগে। বনের ভিতর দিয়ে ইউনিয়ন পরিষদের একটি ছোট রাস্তা ছিল।রাস্তাটি মামারিশপুর হয়ে মল্লিক বাড়ি গিয়েছে।কালের পরিক্রমায় কাঠালী সহ ভালুকা শিল্প নগরী হয়ে উঠে।ঘন বনগুলি পরিষ্কার হয়ে শিল্প মাঠে রুপান্তর হয়।রাস্তাটি প্রশস্ত হয়,মোড়ে দোকান পাঠ গড়ে উঠে এবং রাস্তা দিয়ে ভালুকা থেকে মল্লিক বাড়ী পর্যন্ত গনপরিবহন চলা শুরু হয়,তখনী নউজ্জার বাড়ীর পরিবর্তে স্থানটির নাম হয়ে উঠে মল্লিক বাড়ীর মোড়।নামটি কারো দেওয়া নয়,মল্লিক বাড়ী যাওয়ার রাস্তাটি চেনার সুবিধার জন্য লোকমুখে প্রচলিত ।বর্তমানে বাটার ফ্লাই কম্পানির মধ্য স্থলেই ছিল আমাদের পুরাতন বাড়ী।পশ্চিমে ছিল খাল।আমার জানা মতে কোন স্থান বা রাস্তার নাম কারণ করতে হলে যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে নাম দিয়ে আবেদন করতে হয়।ঐ কর্তৃপক্ষের উপকমিটি নাম গুলি যাচাই বাছাই করে মতামত পেশ করেন।তারপর কর্তৃপক্ষ রেজুলেশন করে স্থান বা রাস্তার নাম করন করেন।বাটার ফ্লাই মোড়ের নাম কে দিয়েছে বা বোর্ড কে সাঁটিয়েছে তা আমার জানা নেই।কেউ বোর্ড সাটিয়ে দিলেই নামকরণ হয়ে যাবে বা ঐ নামে ডাকা শুরু করবে এটি মোটেও বৈধ বা প্রচলিত নয়। মল্লিকবাড়ী মোড়কে কেউ বাটার ফ্লাই মোড় নামে ডাকে আমি শুনি নাই তাহলে ঐরকম বোর্ড সাটানো হাস্যকর বা বোকামী”।।
বিশিষ্ট কবি শিক্ষক সফিউল্লাহ লিটন লিখেছে, “মল্লিকবাড়ী মোড়’কে ‘বাটার ফ্লাই মোড়’ না করার দাবীতে ফেসবুক বেশ উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। সরেজমিনে গিয়ে লোকজনের সাথে কথা বলে মনে হলো সাইনবোর্ডটি ওখানে টানানো হলেও কেউ বাটার ফ্লাই মোড় হিসেবে চেনেনা সবাই মল্লিকবাড়ি মোড় হিসেবেই জানে। ‘মল্লিকবাড়ি মোড়’ নামটির সাথে ওই এলাকার মানুষের ভালোবাসা ও আবেগ জড়িত। মানুষের আবেগ ও অনুভূতিকে মূল্য না দিয়ে ‘বাটার ফ্লাই মোড়’ নাম দিয়ে বাটার ফ্লাই গ্রুপ চরম ধৃষ্টতার পরিচয় দিয়েছে। অবিলম্বে ওই সাইনবোর্ডটি অপসারণ করে ‘মল্লিকবাড়ি মোড়’ নামে একটি সাইনবোর্ড টানানোর জন্য মাননীয় সংসদ সদস্যসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি”।
সাংবাদিক জাহিদুর ইসলাম লিখেছেন,
“প্রচলিত নাম মল্লিক বাড়ী মোড়ই থাকছে। ব্যাক্তি বিশেষ কারো দেওয়া নাম বৈধ নয় সুতরাং উঠে যাবে ।রনি ভাইয়ের ষ্টেষ্টাসে মল্লিকবাড়ী এবং ভালুকাবাসী ঐক্যবদ্ধ হয়েছে”।
সাংবাদিক আসাদুজ্জামান সুমন লিখেছেন, ”এই মোড় ভালুকাবাসী তথা দেশবাসির কাছে মল্লিকবাড়ি মোড় নামেই পরিচিত। কিন্তু বাটারফ্লাই তাদের নামে এই নাম রাখার দৃষ্টতা কিভাবে দেখায়??? বেয়াদবদের বিচার করা উচিৎ। স্থানীয় দালালদের মদদেই এটা করেছে আমার বিশ্বাস। বিষয়টা আমার কাছে খুব দৃষ্টিকটো লাগতো। মল্লিকবাড়ির চেয়ারম্যান আকরাম কাকাসহ অনেকেই বলেছি এ বিষয়ে। মল্লিকবাড়িবাসীর প্রতি অনোরুধ থাকবে এ সাইনবোর্ড তারা তুলে ফেলে দিবে। আমরা আছি আপনাদের সাথে”।
ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষক শহিদুল আলম ক্ষোভ নিয়ে লিখেছেন “সাইনবোর্ডটি সরিয়ে দেয়া কি অসম্ভ ? ৫০ টাকার কালো রং হলে চলবে বলে আমি মনে করি ।খাইয়া কাম নাই মেড়ের নাম পাল্টাইতে আইছে ! হেতানরা ব্রিটিশ বেনিয়াদের মতো আচরন করতাছে” !
রাজনীতিবিদ মিয়া মোহাম্মদ সোহেল এভাবেই লিখেছেন, “কে পরিবর্তন করল আর কেনই বা এই পরিবর্তন তা খতিয়ে দেখতে হবে । আমি তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি । অতি দ্রুত এই সাইনবোর্ড তুলে দিয়ে আইনত ব্যবস্হা গ্রহন করার জন্য সংস্লিষ্ঠ কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি কামনা করছি । কারণ বহুকাল থেকে এই মোরের নাম মল্লিকবাড়ি মোড় নামকরনে
সকলেেই জানে কিন্তু কেউ ইচ্ছা কররেই তা পরিবর্তণ করতে পারে না”।
লেখকঃ উপ পরিচালক, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। সাবেক সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক বাকৃবি সাংবাদিক সমিতি।