|

‘পথিক’ চতুর্থ নিবেদন: বেগম খায়রুন নেছা আফসারের বীরত্ব

প্রকাশিতঃ ১১:৪৫ অপরাহ্ণ | জুন ১২, ২০২০

হাবিবুর রহমান তরফদার:

আমার প্রতিটী লেখা সপ্তাহে একবার বাহির করার কথা, বেগম খায়রুন নেছা আফসার উনি অসুস্হ থাকায় উনার রোগ মুক্তি কামনায় এবং বাঙালী জাতির বীর শ্রেষ্ট সন্তান এর স্ত্রী অসুস্থ বিদায় এই লেখাটি প্রকাশ করলাম আমার স্মৃতি থেকে।

১৯৭৪এর প্রথম দিকের ঘটনা, দিন তারিখ মনে নাই। একদিন সকাল সাত কিংবা আটটার সময় হবে। স্মৃতিসৌধ আগে যে খানে ছিল আমি ওখানে দাড়িয়ে ছিলাম। তখন রাস্তা সলিং ছিল না। হালকা শীত রোদের তাপমাত্রা সাথে বাতাস চলছিল। এমন সময় দক্ষিণ দিকে চেয়ে দেখলাম মেজর আফসার উদ্দিন আহামেদ সাহেব কে কিছু রক্ষী বাহিনীর লোক ধরে নিয়ে আসতেছে।পকেট ওয়ালা ফুলহাতা ওভার কোর্টের মত গায়ে। লুঙ্গি ওলটানো। কমড়ে রশি দিয়ে বাঁধা। দেখা মাত্র আমার ভিতরে ভয়ে কাঁপানো শির শির করে উঠল।

আফসার কাকা আমাকে ছোট থেকেই চিনত, আমার দিকে চাহুনিটা যে করুন সেটা আমি বুঝাতে পেরেছি। আমি এক দৌড়ে বাসায় আসলাম। আব্বাকে বললাম এরপর এক দৌড়ে সিও অফিসের সামনে গেলাম। সিও অফিসের নীচ তলায় থাকত রক্ষী বাহিনী। সিও অফিসের পূর্ব দিক ও পশ্চিম দিকে বারান্দায় রক্ষীবাহিনী পোষাক পড়া অস্ত্র কাধে নিয়ে দাড়ানো। মেজর আফসার উদ্দিন আহামেদ সাহেব বারান্দার কাছে যেতেই রক্ষীবাহিনী আফসার কাকাকে যে গার্ড অফ অনার দিলো, অস্ত্র এবং পায়ের ঠাস ঠাস শব্দের শুরু হয়েছিল সেটা কেউ না দেখলে বুঝতে পারবেন না। আমার নিজ চোখে দেখা।

ক্যাপ্টেন সাহেব মেজর আফসার উদ্দিন আহামেদকে বাহিরে এসে হাত মিলিয়ে ভিতরে নিয়ে গেলেন এটা আমি আজও ভুলতে পারব না। কিছুক্ষণ পর আব্বা গেলেন (ডা. রমজান আলী তরফদার) ক্যাপ্টেন সাহেবের সাথে আমার আব্বার খুব ভাল সর্স্পক ছিল। আব্বা দুই ঘন্টা পর আনুমানিক বাসায় এসে বললেন, ‘ক্যাপ্টেন সাহেব খুব ভাল লোক, ওনার নিজে লুঙ্গি দিলেন আফসার সাহেবকে গোসল করার জন্য। তারপর খাবার দিয়ে আরামদায়ক বিছানা শুতে দিলেন। ঘুমানোর জন্য কারণ সারা রাত ঘুমায়নি।’ (এটা আমার আব্বার মুখের কথা)।

এগার কিংবা বারটার দিগে আফসার কাকার স্ত্রী আমাদের বাসায় আসলেন। আমার ঠিক মনে নেই শেফালী না জসিম কূলে কান্নাকাটি শুরু করলেন। আব্বা আম্মা বুঝালেন কিছুক্ষণ পর থামলেন । তখন আব্বা সাহস দিলেন।তাছাড়া উনিও খুব সাহসী ছিলেন।

১৯৭৪সালে মেজর আফসার উদ্দিন আহামেদ সাহেব কে যখন রক্ষী বাহিনী ধরে নিয়ে আসে ভালুকায় তখন এই ‘সাহসী নারী’ আমার আব্বার সাথে প্রতিদিন এসে যুক্তি পরামর্শ করতেন।

তখন মেজর আফসার স্মৃতি হসপিটাল চালু ছিলো। আমার আব্বা (ডা. রমজান আলী তরফদার) ছিল হসপিটালের দায়িত্বে। তখন হসপিটালের আটটা সাইকেল ছিলো।রক্ষী বাহিনী ওইসব সাইকেল নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় অপারেশন করতে যেত। হসপিটালের সাইকেল নিতে আমার বাবার অনুমতি লাগতো। এভাবেই রক্ষী বাহিনীর অফিসারদের সাথে আব্বার ভাল সর্স্পক ছিল।

বেগম খায়রুল নেছা আফসার একদিন রাত্রে আমাদের বাসায় আসেন একজন কোম্পানী কমান্ডার আর এক জন প্ল্যাটুন কমান্ডার ও আমার বাবা সহ পরামর্শ করতেন। এই সব আলোচনা কখন কি ভাবে হবে তা আমার বাবা আয়োজন করতেন। সিদ্ধান্ত হলো মিছিল করার চিন্তা করার জন্য । রক্ষী বাহিনীর ভয়ে কোন মানুষ সহজে মুখ খুলত না।পশ্চিম ভালুকার মানুষ আফসার সাহেবের খুব ভক্ত ছিলো।ধামশুরসহ আশপাশের বেশ কিছু মহিলা মিছিল নিয়ে বেগম খায়রুল নেছার নেতৃত্বে সিও অফিসের দিকে অগ্রসর হচ্ছেন।আফসার সাহেব সিও অফিসে বন্ধি। মিছিলটি সোনালী ব্যাংক কাছাকাছি গেলে তখন সোনারী ব্যংক ছিল না।হঠাৎ ৪/৭জন রক্ষীবাহিনীর সদস্য মিছিলে এলো পাথারী মারপিট শুরু করেন। তখন কেউ পানিতে, কেউ পায়খানা জঙ্গলে পড়ে সীমাহীন কষ্ট যা বলার মত নয়।

বেগম খায়রুল নেছা আমাদের বাসার রাত আটটা পযন্ত অপেক্ষা করেন। আব্বা ক্যাম্প গেলেন কেপ্টেন সাহব দুঃখ প্রকাশ করলেন। এই মহিলাদের পেটানোর খবর বিদেশী রেডিওতে খবর হয়। সাত জন রক্ষী বাহিনী চাকরী হারায় এই মিছিলে হামলা করার জন্য । তখন আফসার সাহেবে বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি অভিযোগ পড়ে রক্ষীবাহিনীর ক্যাম্পে। এটাও একটা বড় চিন্তা। তিন চার রাত আমাদের বাসায় রক্ষী বাহিনী কমান্ডার প্লাটুন কমান্ডার সহ কি ভাবে উনাকে নিরাপদ করা যায় সে বিষয়ে যুক্তি শুরু করলেন।

অভিযোগ ছিল অস্ত্র মামলার, শেষ সিদ্ধান্ত হলো একটি অস্ত্র জমা দিয়ে মেজর আফসার উদ্দিন আহামেদ সাহেব কে কোর্টে চালান করে দেওয়া। আফসার সাহেবের একটি পিস্তল ছিল লাইন্সেন করা এটা জমা দিয়ে আফসার সাহেব কে কোর্টে চালান করে দেওয়া হলো।

এই মহিয়সী নারী ঐ সময় যে ভূমিকা নিয়ে ছিলেন কত বড় সাহস হলে এই কাজ করতে পারেন। দেশ স্বাধীন হলে আফসার উদ্দিন আহামেদ স্মৃতি হসপিটাল ছিল ভালুকার প্রাণ কেন্দ্র। সব সময় এখানে মানুষের সমাগম থাকতো। ডাক্তার থাকতো, নার্স থাকতো।

আমার একটি কথা মনে পড়ে গেল, বর্তমান এমপির মটর সাইকেল চড়ে পা ভেঙ্গে যায়। তখন মেজর আফসার উদ্দিন আহামেদ সাহেব , সিও অফিসে ছিল হসপিটাল এর দক্ষিণ দিকে ইউনিয়ন বোর্ডের অফিসে থাকতো। এই বর্তমান এমপি ধনু ভাই ঐ ঘরে বসে থাকতে ভাল লাগত না। তখন আমি যেতাম চলো আমাদের বাসায় ঘুরে আসি।আমি কূলে করে আনতাম এবং আবার কূলে করে দিয়ে আসতাম।উনার হয়ত মনে নাই, কারন উনি কূলে চড়ে থাকতেন। আমর মনে আছে এই জন্য ধনু ভাই ছোট সময় অনেক ওজন ছিল। অনেক কথা মনে হয়ে গেলো তাই বলে ফেললাম। এখানে কোন অলংকারিত কথা বলা হয়নি। যার কথা বলেছি আল্লাহ উনার হায়াত দরাজ করুক আমিন ।

লেখক: প্রবীন আওয়ামীলীগ নেতা। ২নং ওয়ার্ড, ভালুকা পৌরসভা, ময়মনসিংহ।

Print Friendly, PDF & Email