যেতে যেতে পথে
প্রকাশিতঃ ৮:৪০ অপরাহ্ণ | অক্টোবর ২৫, ২০২৩

মোস্তাফিজুর রহমান:
প্ল্যাটফর্মে বসে আছি। হঠাৎ দুই বাচ্চা সমেত এক দম্পতি এসে পাশে মালপত্র রেখে দাঁড়ালেন। তাদের দেখে আলাপ করতে কাছে এলো একজন। তারা অবশ্য পূর্ব পরিচিত। গাল তার সিঁদুর রাঙা। ছিমছাম গড়ানার মানুষ। নাম অজানা। লালপেঁড়ে ধবধবে সাদা শাড়ি পড়েছে। গালে টোলও পড়ছিল। দিদিকে ‘সিঅফ’ করতে এসেছে। মানে স্টেশনে বিদায় জানাতে এসেছে।
বিকেল পাঁচটার তিস্তা ট্রেন ধরব বলে হন্তদন্ত হয়ে বাসা থেকে বেরিয়েছি। রিকশায় গেলাম অফিসে। আমার আজকের ভ্রমণসঙ্গী উবায়দুল। খুব কাছের বন্ধুসম ছোটভাই। পুরো নাম উবায়দুল হক। আমি হক সাহেব বলেও ডাকি। ওর হাতে কাজ ছিলো। ঘড়ির কাঁটায় ৪ টা বেজে ৩৫ মিনিট। তাগাদা দিয়ে বের করলাম। তার পর দু’জনে রিকশায়। গন্তব্য ময়মনসিংহ রেলওয়ে জংশন স্টেশন।
আমরা আগে টিকেট পাইনি হাতে৷ চারদিন আগে অনলাইনে ঢুকে কোনো আসন খালি পাইনি৷ তারপর বিকল্প হিসেবে এক ভাইয়ের সহযোগিতা নিলাম। দু’জনের জন্য টিকেট তিনিই ম্যানেজ করেছেন৷ স্টেশনে ঢুকতেই দেখি আমাদের জন্য দাঁড়িয়ে আছে সেই ভাইটির সহকর্মীরা।
এবার ট্রেন আসবে। প্ল্যাটফর্মে অপেক্ষার পালা শুরু। বিকেল ৫ টা ১০ মিনিটে আমাদের ট্রেন তিস্তা ছেড়ে যাবার কথা ছিলো। কিন্তু ট্রেন এলো ৫ টা বেজে ৪০ মিনিটে। জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ বাজার থেকে ছেড়ে আসা ট্রেনটি প্ল্যাটফর্মের এক নম্বর লাইনে এসে দাঁড়ালো। সেই লম্বা এক ট্রেন। তিস্তায় প্রথমবারের মতো যাত্রী হলাম। অবশ্য ট্রেনে চড়ে ঢাকায় যাওয়া এটি দ্বিতীয়বার। এর আগে সড়ক পথেই ঢাকায় যাতায়াত করেছি।
ট্রেনে উঠার সময় প্ল্যাটফর্মের পাশের দোকান থেকে পানি ও হালকা খাবার কিনলো হক সাহেব। তারপর নির্দিষ্ট বগিতে উঠার পালা। ‘ড’ বগিতে যখন উঠতে যাব দেখা হলো প্রিয় একজনের সঙ্গে। মুখভর্তি দাঁড়ি, মাথায় টুপি, পাঞ্জাবি সবই আছে। তিনি যাত্রার রঙ্গমঞ্চ থেকে নিজেকে সরিয়ে মসজিদের মিম্বরে ঠাঁই করেছেন৷ গ্রামীণ নাটকের মঞ্চ মাতানো তুখোর অভিনেতা ছিলেন। নিজের কথার কৌশলে সবাইকে মুগ্ধ করতেন। যখনি উনার সঙ্গে কথা হয় তখনি নতুন ভাবে মুগ্ধ হই। ইসলামের আলোয় আলোকিত সমাজ গড়তে নিরলস কাজ করছেন মানুষটি। তিনি একজন স্কুল শিক্ষকও। তিনি বাদল ভাই। পুরো নাম জানা নেই।
মাগরিবের আজান হয়ে গেছে। তিনি ট্রেনের অভ্যন্তরে নামাজের বগি খুঁজছিলেন।
এবার ট্রেন চলতে শুরু করলো। আমি ও হক পাশাপাশি আসনে। জানালার পাশে বসেছি আমি। পশ্চিম আকাশে সূর্য ডুবছে। লাল-কমলা বর্ণ ধারণ করেছে আকাশ। প্রকৃতির নান্দনিক গোধূলি। চেনা শহর ছেড়ে ট্রেন ছুটছে। আমরা বসেছি উল্টো ভাবে। মানে ট্রেনটি আমাদেরকে পেছেন দিকে টানছে। তাই চেনা শহর ছেড়ে যাওয়া দেখছি অপলক। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের জব্বারের মোড়ের রেল ক্রসিং পাড় করছি। মোড়ে চায়ের দোকানের দুধ চায়ের কথা মনে পড়লো।
ট্রেন চলছে গ্রামের ভেতর দিয়ে। কু-ঝিকঝিক শব্দ। দূরের বাড়িগুলোতে বিদ্যুতের বাল্ব জ্বলছে। কোথাও কুপিবাতি কিংবা হারিকেন নেই। সন্ধ্যের আকাশের রঙ ক্রমশ মিশে যাচ্ছে অন্ধকারে। রেলপথের পাশে এক বাড়িতে দেখা মিলল বিজয়ার বাদ্য। মন্দির থেকে দূর্গা প্রতিমা উঠানে রাখা হয়েছে। বিসর্জন দেবার আগে চলছে নানা আনুষ্ঠানিকতা৷
নামাজ শেষে আমাদের বগিতে আসলেন বাদল ভাই। কথা বলতে চাইলেন। বাদল ভাই যাচ্ছেন মেয়ের কাছে। মেয়েটি ঢাকার একটি কলেজে পড়ে। সে অসম্ভব মেধাবী। তর্কযুদ্ধের তুখোর যুদ্ধা বাদলকন্যা। বাদল ভাই বলছিলেন- সামনে মাসের ৩০ তারিখ তাবলিগে যাবেন। গত তাবলিগে ছিল ১১০ জন সাথীভাই। পাশাপাশি দুটি মসজিদে গিয়েছিলেন। আগামী তাবলিগেও একই অবস্থা হবে। বছর কয়েক আগে আমিও সাথী ছিলাম। কর্ম ব্যস্ততায় এখন যেতে পারি না৷ তবে ‘নসরতে’ যাওয়ার চেষ্টা করি। গত কয়েক তাবলিগে তাও হয়ে উঠছে না। স্মরণ করিয়ে বাদল ভাই ছুটলেন নিজের বগির দিকে।
ট্রেন চলছে। আমরা গফরগাঁও স্টেশনের কাছাকাছি। ট্রেনের ফিরতি টিকেট কাটবো অনলাইনে। রেলসেবা অ্যাপসে চেষ্টা শুরু। অনলাইনে পর্যাপ্ত টাকা না থাকায় ৫০০ টাকা পাঠানোর ব্যবস্থা করলেন আরিফ ভাই। ভাইয়ের কথা অন্য কোনো দিন বলবো৷ টাকা এলো। বগি ও আসন নির্বাচন করে টিকেন নিশ্চয়ন করার পালা। তখন গফরগাঁও স্টেশন অতিক্রম করেছে ট্রেন। অ্যাপসের চাকা ঘুরছে। ঘুরতে ঘুরতে গাজীপুরের শ্রীপুরের কাওরাইদ বাজার স্টেশন। মিনিট পাঁচেকের বিরতি। এর মধ্যে নিশ্চিত হলো আমাদের ফিরতি টিকেট৷
কু-ঝিকঝিক শব্দে চলছে ট্রেন। আকাশে ছোপ ছোপ কালো মেঘ। রেলপথের পাশে চা দোকানে চুলা জ্বলছে। কেটলির ফাঁকে আগুনের স্ফুলিঙ্গ। পাশেই দাঁড়িয়ে নিশ্চিন্তমনে বিড়ি টানছেন অচেনা এক চাচা। বিড়ির ধোঁয়া ছুড়ে দিচ্ছেন আকাশের দিকে। গ্রামের হাট গুলোতে এবেলায় অনেক ভীড়। চা দোকান গুলোতেও মানুষ। টিভিতে চলছে সিনেমা। হঠাৎ আত্মজ মাহির ভিডিও কলে ট্রেন দেখার বায়না শুরু করলো। সে মহাখুশি ট্রেন দেখে৷
আজ আকাশে চাঁদ নেই। মেঘ কেড়ে নিয়েছে চাঁদের শোভা। দক্ষিণে ঘূর্ণিঝড় ‘হামুন’। তারই প্রভাব চারদিকে। হক সাহবের মাথার উপর দাঁড়িয়ে মধ্য বয়সী এক নারী। পুরো পথ দাঁড়িয়ে যাচ্ছেন। শুধু তিনিই নন আরও অনেকে এমন দাঁড়িয়ে রাজধানীর পথে।
বাদল ভাই হঠাৎ ডাকলেন। এশার নামাজ পড়ে ফিরছেন নিজ বগিতে। আগামী তাবলিগের কথা ফের মনে করালেন। কিছু নাস্তা হলো কি না, পানি লাগবে কি না জানতে চাইছেন। ভাইয়ের হাতে তখন পানির বোতল। ট্রেনে উঠার সময় হক সাহেব সঙ্গে নাস্তা নিয়েছিল। সেখান থেকে বাদল ভাইকে জোর করে সামান্য নাস্তা দিলাম।
ট্রেন চলছে। রেলপথের পাশের প্রকৃতির সুধা নেওয়ার সুযোগ নেই। সেবার যখন ট্রেন যাচ্ছিল সবুজ অরণ্যের ভেতর দিয়ে, মুগ্ধ হয়েছিলাম।
আমাদের বগিতে কিছু সময় পরপর হকার আসছে। একেকজন একেক রকমের জিনিস হাতে। কেউ চানাচুর ভাজা, কেউ বার্গার-কাটলেট, কেউ পানি-জুস, কেউ হাতঘড়ি, শিশুদের বই কত কী। আবেগী কণ্ঠে সাহায্য চাইতেও আসছে কেউ কেউ। একজন নারী বলে চলেছেন- ‘আমি একটা অন্ধ মানুষ। আমার দুইডা চোখ নাই। আমি দুইডা চোক্ষে দেখতে পারিনা।’ অনেকেই তার হাতে টাকা গুজে দিচ্ছেন।
চলতি পথে দু’দফা হিজরাদের আগমন। জানতে চাইলাম তাদের গুরু মা কে। জানানোর পর বললাম আমাদের সঙ্গে তোমার গুরু মায়ের চেনাজানা আছে৷ বিরক্ত করো না। হক সাহেব ১০ টাকা দিয়ে বিদেয় করলেন প্রথম জনকে। যাবার বেলায় সে বলে গেলো আর কেউ আসবে না তোমাদের কাছে। টঙ্গীর কাছে আসতেই এবার অন্যজন। সে তো হক সাহেবের শরীরে হাত দেবার চেষ্টা করছে। বারবার স্পর্শ করতে চাইছে। নেইলপলিশ পড়া আঙুল গুলো দিয়ে হকের গালে স্পর্শ করেই চলছে, আর টাকা চাইছে। হিজরাদের নিয়ে কাজ করা বন্ধু সোশ্যাল ওয়েল ফেয়ার সোসাইটির কথা মনে করিয়ে দিলাম তাকে। বললাম, হক সেই সংগঠনের মিডিয়া পার্ট থেকে হিজরাদের সমস্যা সংকট নিয়ে কাজ করে। ওকে বিরক্ত করো না৷ ভেংচি কেটে ও বললো- আমার কাছ থাইক্যা পার পাইয়্যা গেলাইন, ঢাহা গিয়া এইতা কইয়্যা দেহুইন যে।’ এই বলে চলে গেলো।
ট্রেন চলছে আপন গতিতে। ঢাকার খুব কাছে ট্রেন। কনক্রিটের বহুতল ভবন আর রেলপথের পাশের বস্তি গুলো তা জানান দিচ্ছে। হঠাৎ মসজিদে ঝুলন্ত খাটিয়ার দিকে চোখ পড়লো। এই তো ২৩ অক্টোবর ভৈরবে দুই ট্রেনের সংঘর্ষে ঝড়ে গেছে ১৮ প্রাণ। ভেসে উঠে দুর্ঘটনার ভয়াবহ ছবি এবং রেললাইনের পাশে পড়ে থাকা মানুষের ছিন্ন আঙুল ও হাড়।
হেমন্তের এ সময়ে শীতের আগমনী চলছে। কুয়াশা বলে দেয় শীত এসে গেছে। কুয়াশার ভেতরে আধফালি চাঁদ মৃদু দেখাচ্ছে আকাশে। কুয়াশার ভেতর থেকে হঠাৎ ছাতিম ফুলের গন্ধ পেলাম। মনে পড়লো ‘ছাতিম কাঠের কফিন’ টেলিছবি। সেটির লেখক আমার প্রিয়জন ‘ইজাজ আহমেদ মিলন’। আমি মরলে কী ছাতিম কাঠের কফিন পাব? এমন প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল মাথায়।
ট্রেন চলছে কু-ঝিকঝিক। আলো ঝলমলে বিমানবন্দর স্টেশন। প্ল্যাটফর্মে অপেক্ষমান অনেকে৷ গন্তব্যে ভিন্ন সবার।
তিতাস ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে। যাত্রী উঠছে তাতে। মাদ্রাসার জানালার গ্রীল ধরে দাঁড়িয়ে শিশু দেখছে বাইরের বিশালতা৷ যেনো খাঁচায় বন্দী পাখি মুক্ত আকাশে উড়তে চায়। পাশেই উন্নয়নের কর্মযজ্ঞ চলছে। ট্রেনে বসেই দেখছি বিমানবন্দর। নীরবতা ক্যান্টনমেন্ট রেল স্টেশনে।
এবার কমলাপুর স্টেশন। শিশুকালে বইয়ের পাতায় ও বাংলা সিনেমায় দেখেছি এই স্টেশন। কমলাপুর স্টেশন নিয়ে ছেলেবেলায় অনেক কৌতুহল ছিলো। এ বেলায় এসে তা নেই। প্ল্যাটফর্মে ট্রেন দাঁড়ালো। আলেঝলমলে স্বপ্নেদেখা সেই স্টেশনে পা পড়লো। প্ল্যাটফর্মে আধফালি চাঁদ অভ্যর্থনা জানালো।
লেখক: নিজস্ব প্রতিবেদক (ময়মনসিংহ), সমকাল