|

আমাদের একজন সৈয়দ আশরাফ ছিলেন- নঈম নিজাম

প্রকাশিতঃ ১:৫০ অপরাহ্ণ | জানুয়ারি ০৭, ২০১৯

নঈম নিজাম:

একদিন সবাই বলবেন, রাজনীতি মানে খারাপ কিছু নয়। রাজনীতিবিদ মানে অহংকার, ক্ষমতার দম্ভ নয়, বিত্তবৈভবের উৎসব নয়। আমাদের একজন সৈয়দ আশরাফ ছিলেন, যিনি সব কিছুতে ছিলেন আলাদা। একদিন তিনি নিজের বাড়ি বিক্রি করে স্ত্রীর চিকিৎসা করিয়েছেন। লন্ডনে জন্ম নেওয়া মেয়েটিকে বিলাসিতা বুঝতে দেননি। পড়াশোনা শেষে তাকে চলতে হয়েছে একটি ব্যাংকের চাকরি নিয়ে। নিজের সন্তান, স্ত্রীকে রাজনীতিতে টেনে আনেননি। তাদের জন্য কোনো অর্থ রেখে যাননি। তার চিকিৎসা ব্যয় বহন করতে হয়েছিল প্রধানমন্ত্রীকে। একমাত্র কন্যা প্রথমে মা, পরে বাবার পাশে হাসপাতালে সময় দিয়েছেন মাসের পর মাস। মেয়েটি কোনো দিনও বাবার বিলাসিতা চোখে দেখেনি। সাদামাটা জীবনই দেখেছে। অন্যরকম মানুষ ছিলেন আমাদের সৈয়দ আশরাফ।

যতবার এমপি হয়েছেন ততবারই তার সম্পদ কমেছে। সৈয়দ আশরাফের মৃত্যুর পর অনেক এমপির চোখে পানি দেখেছি। ভাই, আপনাদের চোখের পানির দরকার নেই। পারলে একজন সৈয়দ হয়ে দেখান। এমপি-মন্ত্রী হওয়া মানে সম্পদের পাহাড় গড়া নয়, ক্ষমতার দম্ভ নয়। অহমিকায় ডুবে মানুষের সর্বনাশ করা নয়। ক্ষমতা মানে সহনশীলতা, পরমতের প্রতি শ্রদ্ধা। সৈয়দ আশরাফ রাজনীতিবিদদের জন্য পাঠ্যবই। এই বইয়ে আছে, সাদামাটা জীবনের জন্য বামপন্থি হতে হয় না। বুর্জোয়া দলের দ্বিতীয় অবস্থানে থেকেও নিজেকে সাধারণ রাখা যায়। অর্থবিত্তের লোভ-লালসা থেকে দূরে থাকা যায়।

১৯৭৫ সালের পর বাংলাদেশ ছেড়েছিলেন সৈয়দ আশরাফ। দেশে ফিরে ১৯৯৬ সালে এমপি হন। পরে বিমান মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন। জীবনের পথপরিক্রমায় তিনবার মন্ত্রী ছিলেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক দুবার। এরপর প্রেসিডিয়াম সদস্য হন। কিন্তু অন্য দশজনের মতো চলেননি। নিজস্ব একটা স্বকীয়তা নিয়েই তার পথচলা। অনেকটা স্বপ্ন, অনেকটা বাস্তব। ’৯৬ সালে সৈয়দ আশরাফের সঙ্গে পরিচয়। ঘনিষ্ঠতা ও ব্যক্তিগত সম্পর্কের বন্ধনটুকু বাড়ে ওয়ান-ইলেভেনের পর। নরসিংদীর প্রিয় মানুষ রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজু দুপুরে ঢাকা ক্লাবে নিয়মিত আড্ডা জমাতেন। এই আড্ডাতে আমি ছিলাম নিয়মিত সঙ্গী। দুপুর ১২টার আগে রাজু ভাই ফোন দিতেন। কোথায় তুমি? চলে আস। মাঝে মাঝে আমাদের সঙ্গে যুক্ত হতেন আশরাফ ভাই। প্রাণবন্ত মানুষ। সবাইকে মাতিয়ে রাখতেন। কথায় চলনে ছিল উদার গণতান্ত্রিক ভাবনা। কোনো চাওয়া-পাওয়ার হিসাবের ধার ধারতেন না। অর্থ সম্পদের প্রতি কোনো লোভ ছিল না। আশরাফ ভাইয়ের সঙ্গে রাতভর আড্ডায় অনেকবার ছিলাম। সেই আড্ডা হতো সাবেক প্রতিমন্ত্রী ক্যাপ্টেন (অব.) তাজুল ইসলামের গুলশানের বাড়িতে। আশরাফ ভাই আসতেন। তখন তাকে এলজিআরডি মন্ত্রী মনে হতো না। ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদকের ভাবও ছিল না। সময়টা একটু কঠিন ছিল তখন। রাজপথে বিএনপির শক্ত অবস্থান ছিল। আশরাফ ভাই কথা বলতেন মেপে। আমি একবার প্রশ্ন করলাম, বিএনপির আলোচনার প্রস্তাবকে কীভাবে দেখছেন? বললেন, আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সংকট নিরসন করতে হবে। আলোচনার বিকল্প যুদ্ধ। আমরা যুদ্ধ চাই না। শান্তি চাই। বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই। আবার ওয়ান-ইলেভেনের সময় ঢাকা ক্লাবের আড্ডায় তার মাঝে দৃঢ়তা দেখেছিলাম। রাজু ভাই বলতেন, আশরাফ পারবে। তার সাহস আছে, সততা আছে। নেত্রীর প্রতি আনুগত্য আছে। দেশের প্রতি আছে দরদ। বাস্তবে সৈয়দ আশরাফ ছিলেন শেখ হাসিনার নির্ভরতার একটি জায়গা। ওয়ান-ইলেভেনের সময় তার সাহসী ভূমিকা সব মহলে প্রশংসিত। তিনি শেখ হাসিনার পক্ষে শক্ত অবস্থান নেন। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা তখন তাকেই সাহসের প্রতীক মনে করত। তারা অনুপ্রাণিত হতো। তিনি ক্ষমতার অপব্যবহার করেননি। ক্ষমতার ব্যবহার করতে হয়, অপব্যবহার নয়। সৈয়দ আশরাফ সহনশীল, উন্নত চিন্তার মানুষ ছিলেন। তিনি জানতেন, কীভাবে মানুষের ভালোবাসা অর্জন করা যায়। মানুষ ভালোবাসা দিতে জানে। আবার ফিরিয়েও নিতে পারে। তাই এই ভালোবাসা ধরে রাখতে হয়। এ কারণেই মানুষের কাছে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা ছিল সৈয়দ আশরাফের। তিনি স্বচ্ছ ছিলেন কর্মীদের কাছে, শেখ হাসিনার কাছে। ছাত্রলীগের রাজনীতি দিয়ে জীবন শুরু করেছিলেন। বাবার ক্ষমতা দেখেছেন। নিজেও ক্ষমতাবান ছিলেন। কিন্তু কোনো অর্থ-সম্পদ রেখে যাননি। নিজের জীবনকে অতিবাহিত করেছেন সাদামাটাভাবে। রাজনীতির নেতিবাচক কোনো দিক তাকে ঘিরে ধরতে পারেনি। কর্মীবান্ধব ছিলেন। দরদ ছিল দলের জন্য। মানুষের জন্য। এমপি-মন্ত্রী হলে সম্পদ কমে- এই যুগের রাজনীতিতে এমন মানুষের সংখ্যা বিরল। সৈয়দ আশরাফ বিরল মানুষই ছিলেন। আওয়ামী লীগের সর্বশেষ কাউন্সিলে বাংলাদেশ প্রতিদিন অনেকটা খোলামেলাভাবেই ছিল ওবায়দুল কাদেরের পক্ষে। আমি নিজেও টকশোতে বা লেখনীতে কাদের ভাইয়ের পক্ষে যুক্তি দিতাম। ভেবেছিলাম আশরাফ ভাই ভুল বুঝবেন। না তা হয়নি। বাংলাদেশ প্রতিদিনের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে আমন্ত্রণ জানাই। তিনি খুব কম সামাজিক অনুষ্ঠানে যেতেন। আমার সহকর্মী জাহাঙ্গীর জানালেন, আশরাফ ভাই আসবেন। বিশ্বাস করিনি। কিন্তু আমাকে চমকে দিয়ে আশরাফ ভাই এলেন। শুধু এলেন না, অনেকক্ষণ থাকলেন। সবার সঙ্গে কথা বললেন। এমনকি অন্য দলের নেতাদের সঙ্গেও নিজে এগিয়ে কুশলাদি বিনিময় করলেন। আমার সঙ্গে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ আড্ডা দিলেন। কাগজের প্রশংসা করলেন। আমার সব ধারণাই বদলে দেন আশরাফ ভাই। আমরা কেউই চিরস্থায়ী নই। এই জীবনটা বড় কম সময়ের জন্য। গত কয়েক বছরে অনেক প্রিয় মানুষকে হারিয়েছি। ছেড়ে চলে গেছে অনেক বন্ধুবান্ধবও। আশরাফ ভাইকে নিয়ে এই লেখার সময় খবর পেলাম আমার আরেকজন প্রিয় মানুষ মেজর (অব.) জাহাঙ্গীর চলে গেলেন। জাহাঙ্গীর ভাই ছিলেন আমার সিনিয়র বন্ধু। আমার জীবনের অনেকগুলো বছর তার সঙ্গে আড্ডায়, গল্পে কেটেছে। এক সময় তার বাড়িতে জাহাঙ্গীর সাত্তার টিংকু ও আমার অবাধ যাতায়াত ছিল। থাকতেন আরও অনেকে। আমার সঙ্গে যারা চলতেন তারাও সবাই যেতেন আমার সঙ্গে। আমরা একসঙ্গে মিডিয়া করারও চেষ্টা করেছিলাম। নাঈমুল ইসলাম খানের নতুন ধারা কাগজটি তাকে নিয়ে বের করার কথা ছিল। ডিক্লারেশন জাহাঙ্গীর ভাইর নামে হস্তান্তরও হয়। মোহাম্মদপুরে আমরা অফিস নিলাম। পত্রিকাটি হলো না। বিনিয়োগও বেশ হয়েছিল। তারপরও একদিন নাঈম ভাই আমাকে বললেন, নতুন ধারা আমাকে ফেরত নিয়ে দাও। কোনো টাকা-পয়সা ফেরত দিতে পারব না। জাহাঙ্গীর ভাইকে আমি বললাম, দিয়ে দিন। নাঈম ভাই কোনো টাকা-পয়সা দেবেন না। তিনি বললেন, তুমি বলছ? আমি বললাম, হ্যাঁ। জবাবে তিনি বললেন, ঠিক আছে, তুমি যা বলবে তা-ই হবে। আহারে, এমন মানুষদের মৃত্যু সংবাদ শোনার পর নিজের আবেগকে থামিয়ে রাখা যায় না। কান্নায় জেগে ওঠে ভিতরটা। হৃদয়টা ভেঙে যায়। মনে হয় দুনিয়াটা আসলে দুই দিনের। আজ আছি, কাল থাকব না। চলে যাব আমরাও। কিছু কাজ করতে পারলে থেকে যাবে। না পারলে হারিয়ে যাব। কারণ মানুষ যাওয়ার সময় কিছুই নিয়ে যায় না। চলে যায় একা বড্ড নিঃসঙ্গতা নিয়ে। বুকের ভিতরে লুকিয়ে থাকা দহন থেকে যায়। যা কেউই দেখে না। কবি নাজিম হিকমত লিখেছিলেন- ‘বিংশ শতাব্দীতে, মানুষের শোকের আয়ু, বড়জোর এক বছর।’ আহারে মানুষ হিসেবে আমরা তেমনই।

Print Friendly, PDF & Email