নারী পুরুষের প্রতিদ্বন্দ্বী নয় সহায়ক
প্রকাশিতঃ ১:১৫ পূর্বাহ্ণ | মে ১২, ২০১৮

আনোয়ারা নীনা:
কবি সাহিত্যিকের অলংকার সে তো নারী। ‘নারী’ শব্দটি ব্যবহার করা ছাড়া কোন কবি বা কোন সাহিত্যিকই তার লেখার পূর্ণতা প্রকাশ করতে পারেন নি। রূপ, রস, গন্ধ সবকিছুর জন্যই কবি, সাহিত্যিক এই ‘নারী’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। আমি এ কথা বলছি না নারীকে অবমূল্যায়ন করা হয়েছে বরং আমি এটাই বলব নারীরাই জগতের শক্তির উৎস আর প্রেরণা। নারী কোন দিনই কোন অংশেই পুরুষের পেছনে ছিল না। ফ্রান্সের প্যারি কমিউন, ফরাসী বিপ্লব, যুব শ্রমিক আন্দোলনসহ ভারত উপমহাদেশে ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামে পুরুষের পাশেই নারীকে দেখা যায়। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত দাবি নারী সমাজ অর্জন করতে পারেনি। আমাদের সমাজে এখনো কর্মক্ষেত্রে নারীদের মজুরি পুরষের চেয়ে কম। আন্তর্জাতিক ট্রেড ইউনিয়ন কনফেডারেশনের ২০০৯ সালের একটি রিপোর্ট অনুযায়ী বর্তমান বিশ্বে পুরুষের চেয়ে নারীরা ১৬ ভাগ পারিশ্রমিক কম পায়। অন্য আরেকটি পরিসংখ্যানে দেখা যায় নারীরা কাজ করে শতকরা ৬৫ ভাগ। আমাদের এই বিশ্বে বা পৃথিবীতে নারী_পুরুষের সংখ্যার অনুপাত সমান। অথচ বিশ্বের মোট সম্পদের একশ ভাগের মধ্যে মাত্র এক ভাগ সম্পদের মালিক নারীরা। সমাজে এই অবহেলিত নারীদের গৃহস্থালির কাজগুলোকে আর্থিক স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। অর্থাৎ তা অর্থনৈতিক মূল্যে অদৃশ্য থেকে যায়।
মহিলারা বা নারীরা যাই বলি না কেন এখন আমাদের সমাজে খুব ভাল অবস্থানে নেই। তবে বিশ্ব, সমাজ, যুগ যত তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে, ততই এই নারীরা সমাজে এগিয়ে যাওয়ার তীব্র চেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু কিছু কিছু মানুষের লোভ-লালসা, তাছাড়া আরো কিছু অদৃশ্য শক্তি নারীদের পেছনে টেনে ধরে রাখছে। এই সমস্যা থেকে অনেক নারীই উত্তরণ ঘটাচ্ছে। আবার কেউ কেউ পরাজিত হচ্ছে।
আমার কাছে এটা পরিতাপের বিষয় যে ৮ মার্চ বিশ্ব নারী দিবস পালন করা হয়। পৃথিবীর সকল নারীর কাছেই এটা অত্যন্ত আনন্দের ও সম্মানের দিন। নারীর সাফল্যের দিন। আর এই নারীর সফলতার পেছনে তো পুরুষেরও সমান অংশীদারিত্ব রয়েছে। তবে তো পুরুষ দিবস পালন করা হচ্ছে না। মহান আল্লাহ তায়ালা সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। কোথাও বলেন নি পুরুষের কথা বা নারীর কথা। মানুষ বলতে নর ও নারীকে বুঝিয়েছেন। পৃথিবীর সকল সার্থক ও সফল কাজেই নারী ও পুরুষের সমান অবদান রয়েছে। তাই বলে ৮ মার্চ দিবসটি শুধু নারীকে সম্মানিত করার মাধ্যমে সীমাবদ্ধ রাখা ঠিক হবে না। সম্মানের ভাগ পুরুষকেও সমানভাবে দেয়া উচিৎ। নারীর সকল সাফল্যের পেছনে পুরুষের অবদান কোনভাবেই কম নয়। কারণ নরকে বাদ দিয়ে নারী নয়। একটি নতুন প্রাণ সৃষ্টি থেকে শুরু করে প্রতিটি সৃষ্টিশীল কাজে নর ও নারীকে সমানভাবে অংশগ্রহণ করতে হয়। জন্মদাতা পিতা যেমনটি সত্য, গর্ভধারিনী মাতাও তেমনটিই সত্য। একটি শিশুর বৃদ্ধিতে যেমন স্নেহময় পিতার অবদান অনস্বীকার্য, তেমনি মায়ের অবদান সমানভাবে স্বীকৃত।
আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন, ‘হে মানুষ! আমি তোমাদের একজন পুরুষ ও একজন নারী থেকে সৃষ্টি করেছি, পরে তোমাদের বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা একে অপরের সঙ্গে পরিচিত হতে পারো। তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি আল্লাহর কাছে অধিক মর্যাদাসম্পন্ন, যে অধিক মুত্তাকি।’ (সূরা আল-হুজুরাত, আয়াত: ১৩)
এভাবেই মহান সৃষ্টিকর্তা পৃথিবীর সকল কল্যাণে নর ও নারীর ভূমিকা নির্ধারণ করে দিয়েছেন।
বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে নারী সমাজ উন্নয়নমূলক কর্মকা-ে সক্রিয় ও ফলপ্রসূ অবদান রাখছে। আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশেও উন্নয়ন কর্মকা-ে নারীদের অংশগ্রহণ ক্রমেই বেড়ে চলছে। ইতিহাস থেকে জানা যায় নারীই প্রথম কৃষি কাজের সূচনা করেছিল। পুরুষরা যখন শিকারে যেত তখন নারী বাড়ির আশেপাশে ফলের বীজ ছড়িয়ে দিত, চারা লালন করত। এভাবে মানব সমাজে কৃষির উদ্ভব ও বিকাশ হয়েছে। বাংলাদেশে নারী শ্রমশক্তির পরিমাণ প্রায় ৩ কোটি। এর মধ্যে প্রশাসনিক ও ব্যবস্থাপনার কাজে ১০ হাজারের বেশি নারী রয়েছে। ৮০ শতাংশ নারী মৎস্য, বনায়নসহ বিভিন্ন খাতে নিয়োজিত। ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে কর্মরত মহিলা শ্রমিকের সংখ্যা ৩৪ শতাংশ এবং পোষাক শিল্পে নিয়োজিত ৮০ শতাংশই নারী।
তারপরও সমাজে ভাল নেই নারীর অবস্থান। অনেক প্রতিকূলতার মাঝে শুধু টিকে আছে। এই প্রতিকূলতা থেকে উঠে দাঁড়াতে হলে প্রয়োজন পুরুষের সহযোগিতা। প্রতিকূলতা দুই ধরনের- ১. কিছু কিছু অন্তরায় এবং ২. কিছু প্রতিবন্ধকতা। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়- উপযুক্ত শিক্ষার অভাব এবং চলাফেরার ক্ষেত্রে নানা সীমাবদ্ধতার কারণে নারীরা নিজেদের ক্ষমতা ও সুযোগের যথাযথ সদ্ব্যবহার করতে পারে না। এটা এক ধরনের প্রতিবন্ধকতা। আবার প্রায় ক্ষেত্রেই নারীরা মজুরি বৈষম্যের শিকার এবং চাকরি ও শ্রম বাজারে প্রবেশাধিকারের অনেক ক্ষেত্রেই নারীকে বাঁধার সম্মুখীন হতে হয়। এটা এক ধরনের অন্তরায়।
সবশেষে সরকার কর্তৃক ইতোমধ্যে নারীদের জন্য নেয়া নানা বাস্তব পদক্ষেপকে স্বাগত জানাই এবং আগামী দিনে আরো সঠিক পরিকল্পনা ও বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ আশা করছি। তাতে নারী সমাজ আরো ইতিবাচক ও ফলপ্রসূ ভূমিকা রাখতে পারবে বলে আমার বিশ্বাস।
লেখিকা: প্রধান শিক্ষিকা, হালিমুন্নেছা চৌধুরাণী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়।