|

শৈশবের ইকোনো কলম

প্রকাশিতঃ ৩:০০ অপরাহ্ণ | মে ২৭, ২০১৮

মীর আহসান হাবীব বাপ্পী:

আপনার প্রথম কলমের নাম কি? অর্থাৎ আপনি কোন কলম দিয়ে লেখা শুরু করেছেন? ফেসবুকে বেশীরভাগ বন্ধুর উত্তর ছিলো ইকোনো। হ্যাঁ আজ আপনাদের ইকোনো কলমের গল্পই বলবো….
আমি ইকোনো যুগের মানুষ। দাম মাত্র ৩ টাকা। আমি যখন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করি ঠিক সেই সময় ইকোনো কলম মার্কেটে আসে। নানা মজার স্মৃতি আছে ইকোনো কলম নিয়ে। ইকোনো কলম প্রায়ই পেছন দিক দিয়ে কালির উদগীরণ ঘটাতো। স্কুল কলেজের ছেলেদের প্রায়ই দেখা যেতো শার্ট বা প্যান্টের পকেটের নিচে ঘন কালির দাগ নিয়ে ঘুরছে।
এ নিয়ে তেমন কেউ আগ্রহ দেখাতো না। কারণ সকলেই জানে, ৩ টাকার ইকোনো কলম কারণে অকারণে, সময়ে-অসময়ে এই কাণ্ড ঘটায়। এই কাণ্ডের প্রচলিত মজার অদ্ভুত একটি শব্দ ছিলো , ‘কলম হেগে দিয়েছে’! কী অদ্ভুত শব্দ তাইনা? কিন্তু এই একটি শব্দই কি ইকোনো কলমের কাহিনী বর্ণনায় যথেষ্ট? নাহ্ ৩ টাকার ইকোনো কলমের যুগে হঠাৎ চলে এলো একই কোম্পানীর আপগ্রেড সাড়ে ৩ টাকার ইকোনো ডি.এক্স। ইকোনোর চেয়ে পঞ্চাশ পয়সা বেশী।
এই কলম কালো, লাল, নীল রঙেরও হয়। সে সময় যেখানে ইকোনো কলম কিনতে একটু হিমশিম খেতে হয় সেখানে বাড়তি পঞ্চাশ পয়সা দিয়ে লাল, নীল রঙের কলম কেনাতো মোটামুটি অসম্ভবই ছিলো। কেনার কথা বললেই মা বলতো, এগুলো দিয়ে কি কাজ হয়, হ্যাঁ? হয় কিচ্ছু? খালি পয়সা নষ্টের ধান্ধা! অথচ আমার যে কী ইচ্ছে হয়, লাল আর নীল রঙের দু”খানি কলম কিনে বইয়ের পাতার সাদা কালো ছবিগুলোয় রঙ করি, আকাশটাকে নীল করি।
ঘোমটা পরা বউয়ের কপালে টুক করে একটা লাল টিপ এঁকে দেই! আহা! কিন্তু সব ইচ্ছেরা কি ডানা মেলে? লিখতে লিখতে কলমের কালি শেষ! মায়ের কাছে গিয়ে বলি ৩ টাকা দেন, কলম লাগবে। মা এসে তীক্ষ্ণ চোখে কলমের দিকে তাকিয়ে থাকেন, কলমের ভেতর এখানে সেখানে কালি জমে আছে কিনা দেখতে থাকেন। মা আগুনের তাপ দিয়ে সেই জমাটবাঁধা কালি গলিয়ে ফেলেন। আমার আর নতুন কলম কেনা হয় না, জমে থাকা কালি গলে গিয়ে আবার কলমের নিবের কাছে জমা হয়, আরও দুই, চার দিন লেখা চলে এভাবে। আহা কলম! দাগে দাগে ঘ্রাণ… রঙে রঙে প্রাণ… আমার স্বপ্নের ডানা ভাঙ্গা পাখিরা অবশ্য দমে যায়না। ঐ ৩ টাকার ইকোনো কলম দিয়েই আমি কতো- কতো স্বপ্ন বুনি।
রাস্তায় কুড়িয়ে পেলে, কারো কলমের কালি শেষ হয়ে গেলে আমি সেসব যত্ন করে জমিয়ে রাখি, এক, দুই, তিন… তারপর একদিন সেই সব কলমের পেছন আর সামনের দিক আগুনে গলিয়ে একটা আরেকটা সাথে জোড়া লাগাই, তারপর আরেকটা… সেই জোড়া লাগা কলমেরা কত কিছু হয়! কত কিছু !! কাপড় টানানোর হ্যাঙ্গার, খেলনা স্ট্যানগান, নাঙ্গল, জোয়াল, মই আরো কতো কি? একবার কে যেন আস্ত একটা আলনাও বানিয়ে ফেলেছিল আবার স্কুলে গিয়ে, আঙুলের ডগায় টোকা দিয়ে ‘কলম-কলম’ খেলা, কলমের মুখের দিকটা আগুনে গলিয়ে পেছনের ফুটো দিয়ে ফুঁ দিলেই গলে যাওয়া অংশ থেকে অবিকল বেলুনের মত ফুলে যাওয়া স্বচ্ছ গোলাকার বল বের হত, আহা! সে কী উচ্ছ্বাস! কলমের নিবের গুঁতোয় কারো গাল, চোখ, কপাল ফুটো করে দেয়ার ভয়ংকর গল্পও কিন্তু আছে।
একবার ঝগড়া লেগে এক ক্লাসমেটের শরীর ফুটো করে দিয়েছিলাম বেশ রক্ত ঝরেছিলো ঐ বন্ধুটির, তারপর আমার নামে বিচার দেয়া হলো, মনে আছে স্যার আমাকে ৩০ টি বেতের বারি দিয়েছিলো। বেশ কদিন ধরে নানা রকম পুরোনো কথা মনে হচ্ছিল। সেই কলমেরা হারিয়ে গেছে, আমার শৈশবের গল্পের আনন্দের অনুভূতির মতোন। আমার হঠাৎ প্রবল ইচ্ছে হচ্ছে একটা ৩ টাকা দামের ইকোনো কলমের ক্লিপ খুলে নাকের কাছে ধরতে, সেখানে যদি খানিক ঘ্রাণ থাকে কালির ঘ্রাণ, দাগের ঘ্রাণ, গল্পের ঘ্রাণ, শৈশবের ঘ্রাণ, জীবনের ঘ্রাণ, যন্ত্রণারও ঘ্রাণ…! জানি সেই ৩ টাকায় আর কখনোই ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়……

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব

Print Friendly, PDF & Email