কী ঘটছে সেপ্টেম্বরে
প্রকাশিতঃ ১:০১ অপরাহ্ণ | আগস্ট ২৮, ২০১৮

জাহাঙ্গীর আলম: রাজনীতির ভিতরে-বাইরে চলছে নানা তৎপরতা। ভোট রাজনীতি গড়াচ্ছে না সংলাপে। একুশের গ্রেনেড হামলার রায় কী হয় এ নিয়ে বিএনপিতে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। জট খুলছে নাকি কোন পথে যাচ্ছে ভোট রাজনীতি এটাই বড় প্রশ্ন। এই অবস্থায় একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন কড়া নাড়ছে। নির্বাচন কমিশন ও সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের ভাষ্য অনুযায়ী, আগামী ডিসেম্বরের শেষার্ধে জাতীয় নির্বাচন হচ্ছে। আর অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন হবে। এ রকম পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা আগামী সেপ্টেম্বর মাসকে রাজনীতির ক্রান্তিকাল বলে বিবেচনা করছেন। এ মাসেই স্পষ্ট হবে বিদ্যমান রাজনৈতিক সংকট আরও ঘনীভূত হবে নাকি সমাধানের পথ খুলবে। পাশাপাশি এ সময়ে আওয়ামী লীগ-বিএনপি বা এই দুই দলের বাইরে জোট রাজনীতির মেরুকরণও স্পষ্ট হবে। নিবন্ধন বাতিল হওয়া জামায়াতে ইসলামী কী বিএনপির জোটের সঙ্গেই থাকবে নাকি দলটি স্বতন্ত্র অবস্থানে থেকে রাজনীতি করবে সে সম্পর্কেও একটা ধারণা পাওয়া যেতে পারে এই সেপ্টেম্বরে।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি অনেকটাই রাজনৈতিকভাবে পশ্চাতে চলে গেছে। গত পাঁচ বছরে দলটি কোনো কার্যকর রাজনৈতিক কর্মসূচি দিতে পারেনি। দলটি সাংগঠনিকভাবে এলোমেলো অবস্থায় আছে। বলা যায়, একটি প্রবল সংকটকাল অতিক্রম করছে বিএনপি। জিয়া অরফানেজ দুর্নীতি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া গত ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে কারান্তরীণ রয়েছেন। সাজার রায়ের বিরুদ্ধে করা আপিলের রায়ের ওপর নির্ভর করছে বেগম জিয়ার নির্বাচনে অংশ নেওয়া না নেওয়ার বিষয়টি। আগামী ৩১ অক্টোবরের মধ্যে রায়ের আপিল নিষ্পত্তির জন্য হাই কোর্টের প্রতি আপিল বিভাগের আদেশ রয়েছে।
আবার বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দীর্ঘদিন ধরেই লন্ডনে পলাতক জীবন-যাপন করছেন। তিনি কয়েকটি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত। ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা-মামলারও তিনি আসামি। আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, সেপ্টেম্বরে এ মামলার রায় হবে। এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ততার প্রমাণ পেলে তারেক রহমানসহ হারিছ চৌধুরী, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুত্ফুজ্জামান বাবর, সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু সাজাপ্রাপ্ত হতে পারেন। এ ছাড়া বিভিন্ন মামলায় সাজার ভয় রয়েছে বিএনপির শতাধিক কেন্দ্রীয় নেতার। এদের মধ্যে অনেকের নির্বাচনে অযোগ্য হওয়ারও ঝুঁকি রয়েছে। অর্থাৎ আগামী সেপ্টেম্বরেই খোলাসা হবে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের নির্বাচনে অংশ নিতে পারা না পারার বিষয়টি।
বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতারা নির্বাচনে অংশ নেওয়ার কথা মুখে বললেও এ বিষয়টি এখনো স্পষ্ট নয়। কারণ খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানই হবেন এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার শেষ কথা। দলের দুই শীর্ষ নেতার অনুপস্থিতিতে নির্বাচনে যাওয়া না যাওয়ার বিষয়ে দলীয় অবস্থান জানা যেতে পারে আগামী মাসেই। অনেকেই মনে করেন, বিএনপির নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়টি নিশ্চিত নয়। খালেদা জিয়ার মুক্তি, নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা প্রভৃতি বিষয় ফয়সালা না হলে নির্বাচনে না যাওয়ার মতও আছে দলে। আবার দলের একটি অংশ যে কোনো পরিস্থিতিতে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পক্ষে। তাদের যুক্তি হলো— ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে শীর্ষ নেতাদের অনুপস্থিতি, শেখ হাসিনার প্রবাস জীবন এবং সাংগঠনিক বিশৃঙ্খলার মধ্যেও আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ নিয়ে ৩৯টি আসনে জয়লাভ করেছিল। ফলে দলটি তখনকার সময়ে চরম দুর্যোগ অবস্থা সামাল দিতে সক্ষম হয়। তবে বিএনপি শেষ পর্যন্ত কী কৌশল নেয়, তার লক্ষণ সম্ভবত আগামী মাসেই দেখা যেতে পারে।
এদিকে নির্বাচন নিয়ে দুই বড় দলের অবস্থান যা-ই থাকুক না কেন দেশের রাজনীতি এখন নির্বাচনমুখী। আর বড়জোর মাস চারেক বাকি নির্বাচনের। সরকারি দল আওয়ামী লীগ, জাতীয় সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টিসহ ইসলামী দলগুলো নির্বাচনী মাঠে। বিএনপির নেতাদের মাঠের তৎপরতা কম থাকলেও দলীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন তারা। নির্বাচনমুখী এই পরিস্থিতিতে জোটের রাজনীতিও সরগরম হয়ে উঠছে। সামনে চলবে জোট ভাঙা-গড়ার খেলা। অক্টোবরে তফসিল এবং ডিসেম্বরের ভোট এমন রোডম্যাপ ধরেই নির্বাচনী প্রস্তুতি নিচ্ছে আওয়ামী লীগ। পুরনো ১৪ দলীয় জোটকে সমুন্নত রেখেই দলের নেতারা জোট সম্প্রসারণের লক্ষ্য সামনে রেখে অন্য দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন। কিছুদিন আগে দলের সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সঙ্গে আলোচনা করেছেন। তবে ১৪ দলের শরিকদের সঙ্গে আসন বণ্টন নিয়ে এখনো আওয়ামী লীগ কোনো আলোচনার উদ্যোগ নেয়নি। এ নিয়ে শরিক দলগুলোর মধ্যে একটা ক্ষোভ আছে। তবে জোট রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ দুই রকম কৌশল নিয়ে এগোচ্ছে বলে শীর্ষ নেতারা জানিয়েছেন। বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিলে এক রকম আর না নিলে আরেক রকম কৌশল থাকবে দলটির। এ কারণে বিএনপির কৌশলের প্রতি লক্ষ্য রাখছে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়। বিএনপি নির্বাচনে এলে আওয়ামী লীগ ১৪ দলসহ জাতীয় পার্টিকে নিয়ে নির্বাচনী সমঝোতা করবে। আর বিএনপি না এলে কেবল ১৪ দলকে নিয়ে জোটগত নির্বাচন করার পরিকল্পনা আছে দলটির। এক্ষেত্রে মিত্র দল জাতীয় পার্টি আলাদা নির্বাচন করতে পারে। সেপ্টেম্বরে রাজনৈতিক গতি-প্রকৃতি দেখেই শরিকদের সঙ্গে আসন বণ্টন নিয়ে আলোচনা করতে চায় আওয়ামী লীগ। এ কারণে রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে আগামী মাসটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
জোট রাজনীতিতে বিএনপি মিত্র দল জামায়াতে ইসলামী সম্পর্কে কী সিদ্ধান্ত নেয় তা দেখার অপেক্ষায় রয়েছে রাজনৈতিক অভিজ্ঞমহল। সম্প্রতি সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে এই দুই শরিক দলের মধ্যে টানাপড়েন দেখা দেয়। বিএনপি কী শেষ পর্যন্ত জামায়াতকে সঙ্গে রাখবে না, নাকি ১৯৯১ সালের নির্বাচনের মতো গোপন আঁতাত করবে কিংবা তাদের জোটের বাইরে রাখবে তা দেখার অপেক্ষা করছে অভিজ্ঞমহল। এ ছাড়া আওয়ামী লীগ-বিএনপির বাইরে বিশিষ্ট আইনজ্ঞ ড. কামাল হোসেন, সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী, আ স ম আবদুর রব ও মাহমুদুর রহমান মান্নার সমন্বয়ে অপর একটি জোটের কথা শোনা যাচ্ছে। আবার বাম রাজনৈতিক দলগুলোর সমন্বয়ে আরেকটি জোট আত্মপ্রকাশেরও উদ্যোগ আছে।
এদিকে বিএনপি চাইলেও নির্বাচন নিয়ে সরকার বা আওয়ামী লীগ কোনো সংলাপের উদ্যোগ নেবে না। দলটি মনে করে, সংবিধানের আওতায় নির্বাচন হবে। এখানে সংলাপের কোনো প্রয়োজন দেখছেন না তারা। গত রবিবার একটি সংবাদপত্রে দেওয়া সাক্ষাৎকারে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, বিএনপি নির্বাচনে না এলেও দেশে নির্বাচন বন্ধ থাকবে না। আবার একই সংবাদপত্রে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, বিএনপি ছাড়া দেশে নির্বাচন হবে না। দুই বড় দলের এই বিপরীতমুখী অবস্থানের মধ্যে আগামী নির্বাচন কেমন হবে তা দেখার জন্য সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত অপেক্ষা করতেই হবে।
সুত্র: বাংলাদেশপ্রতিদিন.