দুই পাগলের হেতুময় অহেতুক কাহিনী
প্রকাশিতঃ ৯:৪৬ পূর্বাহ্ণ | সেপ্টেম্বর ৩০, ২০১৮

গোলাম মাওলা রনি: সেদিন আমাদের ছোট্ট গ্রাম্য শহরে এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। শহরের মধ্যে দুটো পাগল এমনিতেই বহুদিন ধরে একের পর এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটিয়ে যাচ্ছিল। পাগলেরা উভয়েই ছিলেন তাগড়া যুবক এবং ধনাঢ্য ও প্রভাবশালী পরিবারের সন্তান। আমরা একজনের নাম দিয়েছিলাম বড় পাগলা আর অপরজনের নাম ছোট পাগলা। বড় পাগলা তুলনামূলকভাবে বয়সে বড় এবং আকার-আকৃতিতে ছিলেন বিশাল। অপরদিকে ছোট পাগলার গড়ন ছিমছিমে পাতলা হলেও নানা কারণে সে ছিল দুর্ধর্ষ। বড় পাগলা হাঁফডাক করতেন বেশি এবং তার চেয়েও বেশি উৎপাত করে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করতেন। তিনি হাতে মস্তবড় এক লাঠি নিয়ে ঘুরতেন এবং রাতবিরিতে ইচ্ছামতো বিভিন্ন ঘরবাড়ির দরজা, জানালা কিংবা টিনের বারান্দায় আঘাত করে লোকজনকে ভয় দেখাতে ভীষণ ভালোবাসতেন। জনগণকে বিব্রত করার জন্য তিনি মাঝেমধ্যে জনবহুল রেস্তোরাঁ, হাটবাজার, মসজিদ-মন্দির অথবা দলবেঁধে মহিলারা যেখানে গোসল করতেন সেখানে গিয়ে বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ নিজের পরনের লুঙ্গি ও কাপড়-চোপড় খুলে পুরো উদোম হয়ে ধ্যাতাং ধ্যাতাং নাচ শুরু করতেন। ছোট পাগলা ছিলেন চুপচাপ প্রকৃতির। তিনি মাথা নিচু করে পুরো শহরময় হেঁটে বেড়ানোর সময় আপন মনে বিড়বিড় করে কী যেন বলতেন আর দাঁত কিড়মিড় করে নানাভাবে চোখ পাকাতেন। উভয় পাগলই দোকানপাটে ইচ্ছামতো জিনিসপত্র দাবি করতেন যা সাধারণত চানাচুর, বিস্কুট, কলা বা চা-মিষ্টির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকত এবং দোকানদাররা ঝামেলা এড়ানোর জন্য পাগলের দাবিনামা সঙ্গে সঙ্গে মিটিয়ে দিতেন। আমরা অবাক হয়ে লক্ষ্য করতাম যে, বড় পাগল ও ছোট্ট পাগল উভয়েই উভয়কে পরিহার করে চলতেন। কদাচিৎ মুখোমুখি হলে তারা কথা বলতেন না এবং কোনোরকম বিবাদে জড়াতেন না। আমাদের আশির দশকের একদম শুরুর দিকটার সেই গ্রাম্য শহরের রসিক লোকজন আশা করতেন যে দুই পাগল ক্ষণিকের তরে হলেও একটু আধটু নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করুক এবং তাদের পাগলামির পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে আনন্দ দিক। লোকজন সাধারণত সুস্থ মানুষের ঝগড়া-বিবাদ, বিনোদন আনন্দ ও বন্ধুত্ব দেখতে অভ্যস্ত। কিন্তু বদ্ধ উš§াদরা ঝগড়া করলে কী হয় অথবা ঝগড়ার সময় তারা কী কী বলেন তা নিয়ে আম-আদমির আগ্রহ ও ঔৎসুক্য চিরন্তন বিধায় আপনারা আমাদের শহরের সেই সময়ের লোকদের দয়া করে মন্দ কিছু বলবেন না।
দিন যায় কাল যায় মাস যায় আর আমাদের দুই পাগলের পাগলামিও বেড়ে যায়। পাগল হিসেবে তাদের স্বৈরাচারী মনোভাব, দাম্ভিকতা, আত্মবিশ্বাস এবং লোকদের ভয় দেখানোর কুপ্রবৃত্তি রীতিমতো আতঙ্কজনক অবস্থায় পৌঁছে যায়। তাদের বাধা দেওয়া, প্রতিবাদ করা কিংবা শায়েস্তা করার সাহস ও শক্তি আমাদের কারোরই ছিল না। আমরা সবাই দুই পাগলকে পাত্তা দিয়ে চলতাম এবং যার সঙ্গে পাগলের বেশি খায়-খাতির রয়েছে তারা রীতিমতো গর্ব অনুভব করতাম। পাগলেরা সম্ভবত আমাদের দুর্বলতা ও অক্ষমতা টের পেয়ে গিয়েছিলেন। এ কারণে তারা রীতিমতো গবেষণা করে নিত্যনতুন বাহারী এবং চমকপ্রদ পাগলামি কা- করে বেড়াতেন। তাদের পাগলামির ধরনটাই ছিল এরূপ যে, তাদের দ্বারা যারা ক্ষতিগ্রস্ত হতো তারা সমাজে নানাভাবে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তেন এবং অন্য সবার হাসির খোরাক হতেন। তাদের পাগলামির একটি নমুনা বললেই বিষয়টি হয়তো আপনারা পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারবেন।
আজকের নিবন্ধে আমি যে দুজন পাগলের কথা বলছি তারা আশির দশকের প্রথম কয়েক বছরজুড়ে আমাদের শহরে অর্থাৎ পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলার উলানিয়া বন্দরে পাগলামি করতেন। ওই বন্দরে তখন না ছিল বিদ্যুৎ আর না ছিল থানা-পুলিশ বা প্রশাসনের কোনো অফিস। সরকারি অফিস বলতে একটি তহসিল অফিস ছিল যার কর্তা অর্থাৎ তহসিলদারকে সবাই বড় সাহেব বলতেন। তিনি বরিশাল শহরের বাসিন্দা ছিলেন। লোকজন তাকে বাঘের মতো ভয় পেতেন। অন্যদিকে তিনি দুই পাগলকে ভয় পেতেন যমের মতো। পাগলের আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য তিনি সদলবলে হাঁটতেন এবং পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করে ঘুমাতে যেতেন। শহরের অন্যান্য দাপুটে সিংহ পুরুষ যাদের ভয়ে বাঘে-মোষে এক ঘাটে পানি খেত তারাও দুই পাগলের ভয়ে সর্বদা তটস্থ থাকতেন। শহরের সুন্দরী কুলবধূদের নিয়ে তাদের আত্মীয়স্বজনের চিন্তার অন্ত ছিল না। কারণ বড় পাগলা যদি কারও সামনে বস্ত্রহীন হতেন তবে পরবর্তী অনেক দিন পর্যন্ত বেশিরভাগ নারী-পুুরুষ সেটা নিয়ে নানামুখী রসাত্মক আলোচনা করে হতভাগী কুলবধূদের জীবন দুর্বিষহ করে তুলতেন।
আমাদের শহরে সেকালে একটি মাত্র ভাঙাচোরা মসজিদ ছিল। জুমার দিনে শখানেক লোক এবং অন্যান্য ওয়াক্তে কুড়ি-পঁচিশজন মানুষ নিয়মিত মসজিদে যেতেন। মাগরিব এবং এশার সময় মৃদু হারিকেনের আলোতে মসজিদের ভিতর কেবল হারিকেনটিই দেখতে পাওয়া যেত। বাকি সব আবছা আলো-আঁধারিতে ছায়ার মতো মনে হতো। মসজিদের দরজা ছিল ভাঙা, বেড়াগুলোও ছিল জীর্ণশীর্ণ। পশ্চিমদিকের বেড়াটি ছিল ছয় ফুট উঁচু এবং বেড়ার উপরে প্রায় তিন-চার ফুট জায়গা দীর্ঘদিন যাবৎ ফাঁকা ছিল। অর্থের অভাবে পশ্চিমের বেড়াটির ওপরের অংশ মেরামত করা যাচ্ছিল না, যা নিয়ে মুসল্লিরা বেশ চিন্তিত ও আতঙ্কিত ছিলেন। কারণ পশ্চিম দিকটায় অর্থাৎ বেড়ার অপর পাশটা ছিল জঙ্গল ও আগাছায় পরিপূর্ণ। সাপ-কীটপতঙ্গের আতঙ্ক এবং পাখির যন্ত্রণায় রাতবেলায় নামাজিদের মনোযোগ নষ্ট করত। ফলে ফজর, মাগরিব এবং এশার ওয়াক্তে সবাই একটু বাড়তি সতর্কতা নিয়ে চোখ, কান খোলা রেখে ধর্মকর্ম করতেন।
মসজিদে সাধারণত মধ্য বয়স্ক লোকেরাই আসতেন এবং তাদের মধ্যে গণ্যমান্য ও অভিজাত লোকের সংখ্যাই ছিল বেশি। দুই তিনজন মুসল্লি ছিলেন রাতকানা। তারা সাধারণত অন্যের হাত ধরে মাগরিব-এশা ও ফজরের ওয়াক্তে মসজিদে আসতেন। রাত কানাদের মধ্যে একজন ছিলেন শহরের সবচেয়ে সম্মানিত, ধনবান এবং প্রভাবশালী ব্যক্তি যাকে সবাই তালুকদার সাহেব বলে সম্বোধন করতেন। ঘটনার দিন সন্ধ্যায় অর্থাৎ মাগরিবের সময় মুসল্লিরা সবাই সেজদায় ছিলেন। এমন সময় হালকা মৃদু শব্দে পেছনের সারির একজন বয়স্ক মুসল্লি সেজদারত অবস্থায় মাথাটি একটু কাত করে শব্দের হেতু বোঝার চেষ্টা করলেন। প্রাকৃতিক কারণেই তিনি হয়তো কোনো কীট-পতঙ্গ-সাপ বা অন্য কোনো পাক-পাখালির আগমনী শব্দের আশঙ্কায় ঘাড়টি বাঁকা করেছিলেন। কিন্তু তিনি যা দেখলেন তাতে করে সেজদারত থাকা তার কাছে নিরাপদ মনে হলো না। তিনি বিবস্ত্র বড় পাগলাকে ভরা সন্ধ্যায় লাঠি হাতে মসজিদের ভিতর দাঁড়ানো অবস্থায় দেখে মাথা ঠিক রাখতে পারলেন না। ওরে বাবা! বড় পাগলা! ন্যাংটা! লাঠি! বাড়ি দেবে ইত্যাদি কয়েকটি এলোমেলো শব্দের অতি চিৎকারের ঝঙ্কার তুলে মুুরব্বি সেজদা ফেলে দিলেন ভোঁ দৌড়। মুহূর্তেই মসজিদের মধ্যে শুরু হলো হুড়োহুড়ি। একটি মাত্র দরজা দিয়ে সব লোক বের হতে গিয়ে কী কী করল তা নিয়ে বিস্তারিত না বলে রাতকানা তালুকদার সাহেবের কাহিনী বলে মূল প্রসঙ্গে চলে যাব। উপরোক্ত ঘটনার পরের দিন পুরো শহরের ঘরে ঘরে-পথে ঘাটে এবং চায়ের দোকানে একটাই আলোচনা তালুকদার সাহেব অন্ধকারের মধ্যে কীভাবে দরজা খুঁজে পেলেন এবং নিরাপদে আপন আলায়ে ফিরলেন। ঘটনার সময় উপস্থিত কয়েকজন মুসল্লির সাক্ষ্য-প্রমাণসহ জবানবন্দিতে জানা গেল যে, তালুকদার, সাহেব পশ্চাৎমুখী হয়ে দরজার দিকে না এসে সোজা পশ্চিমদিকের ছয় ফুট উঁচু বেড়া টপকে জঙ্গলের মধ্যে লাফ দিয়েছিলেন এবং রাতের আঁধার, সাপ-ব্যাঙ পতঙ্গের ভয় এবং আগাছার জঞ্জাল পাড়ি দিয়ে অসীম সাহসে নিরাপদে এক দৌড়ে আপনগৃহে পৌঁছে গিয়েছিলেন। তখনকার দিনের ডিস এন্টেনা, টেলিভিশন, মোবাইল ও নাটক-সিনেমাবিহীন একটি গ্রাম্য শহরে বড় পাগলা ও রাতকানা তালুকদারের কাহিনী বহুদিন পর্যন্ত মানুষকে বিনোদনের সাগরে ভাসিয়ে রেখেছিল।
আমরা আলোচনা করছিলাম দুই পাগলের নিত্যনতুন পাগলামি নিয়ে যা তারা সম্ভবত ভেবেচিন্তে করতেন যাতে করে একশ্রেণির মানুষ বিনোদিত হয় এবং অপর শ্রেণি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পাগলেরা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী নীতির আদলে আমাদের শহরে অত্যন্ত চমৎকারভাবে ডিভাইড অ্যান্ড রুল পলিসি বাস্তবায়ন করেছিলেন। শহরবাসীর একাংশ হঠাৎ করেই পাগল সমর্থক হয়ে উঠলেন। তারা পাগলদের দেখলে আনন্দে হৈ হুল্লা করে উঠতেন এবং নিজেদের কথা-কর্ম ও আচরণ দ্বারা পাগলদের এমনভাবে উৎসাহ দিতেন যেন তারা নতুন নতুন পাগলামি করে তাদের আনন্দের মাত্রা বাড়িয়ে দেন। পাগলও সুযোগ বুঝে নিজেদের কর্মী-সমর্থক ও ভক্ত অনুরাগীর সংখ্যা বাড়াতে লাগলেন। ফলে অতি অল্প সময়ের মধ্যে তারা হয়ে উঠলেন প্রভাবশালী ও জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব। পাগলভক্তরা অনেক সময় মূল্যবান উপহার ও টাকা-পয়সা দিয়ে পাগলদের নিজেদের প্রতিপক্ষ বা শত্রুর বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিতেন। বিপরীতে পাগল দ্বারা আক্রান্ত অথবা ক্ষতিগ্রস্তরা নীরবে মুখ বুজে সবকিছু সহ্য করতে থাকলেন এবং সাধ্যমতো অভিসম্পাত দ্বারা পাগল ও তাদের কর্মী-সমর্থকদের বংশের নিকুচি করতেন।
দুই পাগলের পাগলামি নিয়ে তাদের ভক্ত-অনুরাগীদের আশা-আকাক্সক্ষা দিনকে দিন বেড়েই চলল। তারা প্রায় প্রতিদিনই নিত্যনতুন পাগলামি দেখতে চাইতেন এবং পাগলদের দ্বারা সম্মানিত ব্যক্তিবর্গ, সুন্দরী নারী এবং ধনবান লোকজন ক্ষতিগ্রস্ত হোক এমন চিন্তায় বিভোর থাকতেন। এভাবে চলতে চলতে তারা এক সময় চাইলেন দুই পাগলের ঝগড়া হোক। দুই পাগলের সমর্থকরা নিজেদের মধ্যে প্রায়ই বাহাস করে বলতে আরম্ভ করলেন যে, আমাদের পাগলের সঙ্গে তোমাদের পাগল পারবে না। বড় পাগলের লোকজন বললেন আমাদের পাগল যদি একবার রেগে যায় তবে তোমাদের পাগলের খবর আছে। একটা আছাড় দিয়ে পেটের নাড়িভুঁড়ি বের করে দেবে। ছোট পাগলের লোকজন উত্তরে বলতেন গোখরা সাপ দেখছ! বেশি বড় না-কিন্তু একবার ছোবল মারলে গরু-মহিষ, হাতি-যাই হোক দুই মিনিটে চিৎপটাং হয়ে পড়বে। তারা পরস্পরের সঙ্গে বাহাস করার পাশাপাশি দুই পাগলকে একত্র করে তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত বাধিয়ে দেওয়ার জন্য প্রাণান্ত চেষ্টা করতে লাগলেন। কিন্তু আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি, পাগলেরা ঝগড়া-বিবাদ তো করতেনই না-বরং একজন আরেকজনকে দেখামাত্র নিশ্চুপ হয়ে যেতেন এবং উপস্থিত লোকজনের শতমুখী প্ররোচনা সত্ত্বেও টুঁ-শব্দটি না করে স্থান ত্যাগ করতেন। উল্লিখিত অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে দুই পাগলের সমর্থকরা বেশ হতাশ ও ম্রিয়মাণ হয়ে পড়লেন। বেশ কয়েকদিন তারা তাদের পাগলদের পক্ষে তৎপরতা বন্ধ রাখলেন। পাগলদের গুরুত্ব কিছুটা হলেও কমে গেল। এরই মধ্যে হঠাৎ করে একদিন বিকালে বহু কাক্সিক্ষত অদ্ভুত সেই ঘটনাটি ঘটল যার কথা আমি নিবন্ধের শুরুতে বলেছিলাম। ঘটনার দিন শহরবাসী কয়েকজন দেখলেন যে, দুই পাগল মারামারি শুরু করেছে। উত্তেজনাকর এ খবর মুহূর্তের মধ্যে শহরময় রাষ্ট্র হয়ে গেল। দলে দলে লোক ঘটনাস্থলের দিকে ছুটল তামাশা দেখার জন্য। ছেলে-বুড়ো-আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সবাই ছুটল। প্রায় হাজারখানেক লোক জড়ো হয়ে মহা উৎসাহে দুই পাগলের মারামারি দেখতে লাগল। বড় পাগল তার লাঠি হাতে বিশাল লম্ফঝম্প শুরু করে দিল। কিন্তু অন্যান্য দিন তিনি যেভাবে হঠাৎ করে বস্ত্রহীন হয়ে পড়েন সেদিন রহস্যজনকভাবে তেমনটি করলেন না। তিনি সম্ভবত তার প্রতিপক্ষের আক্রমণের কেন্দ্র হিসেবে নিজের দুর্বলতম স্থানটিকে সহজলভ্য করতে চাইছিলেন না। প্রতিপক্ষ অর্থাৎ ছোট পাগল ছিলেন নিরস্ত্র। বড় পাগল তার বিশাল লাঠি দিয়ে যেই না ছোট পাগলকে আঘাত করতে গেলেন ওমনি সে সিনেমা স্টাইলে চ্যাংদোলা দিয়ে নিজেকে বাঁচিয়ে বড় পাগলকে খামচি মেরে দিলেন। উৎসুক জনতা ওই দৃশ্য দেখে উত্তেজিত হয়ে পড়লেন এবং তালি বাজিয়ে শাবাশ শাবাশ বলে উৎসাহ দিতে থাকলেন।
দর্শক সারির লোকজন দুই পাগলের মারামারি দেখতে দেখতে তাদের মধ্যে কিছু লোক পরস্পরকে জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন কীভাবে মারামারি লাগল, এইটা কী ধরনের কাজ। একজন লাঠি হাতে মারছে অন্যজন খালি হাতে আত্মরক্ষা করছে! দেশে কি আইন-কানুন নাই মায়া-দয়া কি ওঠে গেল নাকি! হায় আল্লাহ! এখন কী হবে কেয়ামতের বোধ হয় বেশিদিন বাকি নেই। একদল লোক যখন এমন সব কথাবার্তা বলছেন তখন পাগল সমর্থকরা নিজেদের পাগলের বিজয় নিশ্চিত করার জন্য সমস্বরে উত্তেজনাকর সেøাগান তুলে, তালি বাজিয়ে এবং শিস দিয়ে পরিস্থিতিকে উত্তেজনাময় করে তোলার প্রাণান্ত চেষ্টা করতে লাগলেন। বড় পাগল শত চেষ্টা করেও শেষ পর্যন্ত ছোট পাগলের গায়ে একটি লাঠির আঘাত বসাতে পারলেন না। ছোট পাগল শুধু তিড়িং বিড়িং লাফিয়ে এবং মার্শাল আর্টের কায়দায় শো সাঁ শব্দ করে বড় পাগলের মনোবল ভেঙে দিলেন। অবশেষে সবাইকে হতবাক করে দিয়ে বড় পাগল রণে ভঙ্গ দেওয়ার আগে ছোট পাগলকে উদ্দেশ করে মহা তাচ্ছিল্যভরে বললেন ‘শালায় একটা পাগল’।
উপরোক্ত ঘটনার পর আশ্চর্যজনকভাবে দুই পাগলের বন্ধুত্ব হয়ে গেল। তাদের পাগলামিও ধীরে ধীরে কমে গেল। তাদের সমর্থকরা হতাশ হয়ে পড়লেন। আমাদের শহরের বিনোদন বাণিজ্যে ভাটা পড়ল। এরই মধ্যে কোনো এক ঝড়ের রাতে ছোট পাগল ঝড়ের তা-বে বিধ্বস্ত ঘরের নিচে পড়ে নির্মমভাবে মারা গেলেন। কিছু দিন পর বড় পাগলও মারা গেলেন। আলোচ্য ঘটনাকে রূপকথার গল্পের মতো শোনালেও এর প্রতিটি ঘটনা সত্য যার মাধ্যমে আমাদের মনমানসিকতা, মূল্যবোধ, চিন্তা-চেতনা ও অভ্যাসের একটি পরিচয় ফুটে উঠেছে। ঘটনাটি ঘটেছিল আজ থেকে প্রায় ৩৮ বছর আগে দক্ষিণবঙ্গের এক অজ গ্রাম্য শহরে। ঘটনার এত বছর পর আমাদের সভ্য সমাজের মনমানসিকতা, চিন্তা-চেতনা, কথাবার্তা ও আচরণ উল্লিখিত ঘটনার পাত্র-পাত্রীদের থেকে কতটুকু উন্নত হয়েছে তা বিচার করার ভার সম্মানিত পাঠকদের ওপর ছেড়ে দিলাম।
লেখক : কলামিস্ট ও সাবেক সংসদ সদস্য।
সুত্র: বাংলাদেশপ্রতিদিন।